এম আবদুল হাফিজ
কী করে সারাবিশ্বের সঙ্গে প্রতিযোগিতা করে তারা নিজ নিজ কর্মস্থলে টিকে আছে! ওই একটি মন্ত্র স্বাধীনতার স্বপ্নবীজ তাদের সেই প্রতিযোগিতায় উজ্জীবনী শক্তি দিয়েছে। যদিও তাদের অভিবাসনের প্রক্রিয়া অবশ্যই কুসুমাস্তীর্ণ হয়নি। আমাদেরই জনশক্তি দালালরা তাদের পদে পদে প্রতারণা করেছে, এগোনোর পথে হোঁচট খাইয়েছে। আজ যখন প্রধানমন্ত্রী বিশ্বব্যাংককে 'না' করে দিয়ে নিজস্ব অর্থায়নে পদ্মা সেতু নির্মাণের কথা বলেন, তার নেপথ্য শক্তি ওইসব নাম-পরিচয়হীন, খেটে খাওয়া মানুষ; এ দেশের কোনো বিড়লা বা টাটারা নয়।
এই শক্তির আরও উৎস আমাদের কৃষককুল, যারা একটুখানি প্রণোদনা পেলে একই মাটি থেকে অন্তত তিনগুণ অধিক ফসল ফলাতে সক্ষম। ১৯৭২-এ বাংলাদেশের বিপুল খাদ্য ঘাটতি ছিল, যা সদ্যস্বাধীন দেশটি উত্তরাধিকারসূত্রেই সংযুক্ত পাকিস্তান থেকে পেয়েছিল। আজ ওই মাটি থেকেই খাদ্য উৎপাদন করে প্রয়োজনীয় আরও কয়েখ লাখ টন খাদ্য আমদানি থেকে অব্যাহতি দিয়ে আমাদের কৃষকরা অনেক ত্যাগ-তিতিক্ষায় অর্জিত স্বাধীনতার প্রতি দায়বদ্ধতা থেকে নিজেদের মুক্ত করেছেন।
স্বাধীনতা এক অমূল্য সঞ্জীবনী শক্তি, যার স্পর্শে আমাদের ছেলেমেয়েরা অবলীলায় এভারেস্টের চূড়ায় ওঠে। ক্ষেতে-খামারে খাটে। দায়িত্বশীল পদ অলঙ্কৃত করে। এ সবকিছুই সম্ভব হয়েছে স্বাধীনতার কারণে, যেখানে যোগ্যতা থাকলে যে কোনো প্রতিবন্ধকতা উতরানো যায়। আমাদের নারী কর্মজীবীরা মানবসম্পদ সূচকে এই অঞ্চলে একটি ঈর্ষণীয় অবস্থান দখল করে আছে। অজপাড়াগাঁর ছমিরন-করিমনরা আজ পরনির্ভর না থেকে খানিকটা স্বাচ্ছন্দ্যের খোঁজে সূচিশিল্পে যোগ দিয়ে বিপুল পরিমাণ বৈদেশিক মুদ্রার সংস্থান করেছে আমাদের তৈরি পোশাকের বাজারে। শোনা যায়, বিশ্ব গার্মেন্ট বাজারে এদেরই একাধিপত্য ভাঙতে বড় বড় প্রতিযোগী মাঠে নেমেও সাফল্য কুড়োতে পারেনি।
একটি প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর দেশে আমরা যে একেবারে খারাপ নেই বা আমরা যে নেহাত ব্যর্থ নই_ দেশটির চেহারা দেখলেও কি তা বিশ্বাস হয় না? আজ এ দেশে কাজের বুয়ারাও সেলফোন ব্যবহার করে। নিম্ন বেতনভোগী মেয়েরাও জিন্স পরে। আমি আমার বসবাসের এলাকায় ঠিকা ঝিদেরও নগ্ন পায়ে দেখি না। একটি সাফল্যের চিত্র আমাদের মতো দেশেও সুদূরপরাহত নয়। প্রান্তিক জনগণও এখন আশাবাদী এবং তারা কষ্ট-দারিদ্র্যের মধ্যে থেকেও সে আশাবাদ পোষণ করে এবং নগদ নগদ জীবনকে উপভোগ করতে চায়। সরকারি আনুকূল্যের অযথা প্রতীক্ষায় না থেকে তারা নিজেরাই তাদের সমস্যার জট খুলতে চেষ্টা করে। এটাই হলো এ দেশের ইতিবাচক দিক এবং সাফল্যের চালিকাশক্তি।
তবে হরিষে বিষাদও আছে। যখন দেশের অমিত সম্ভাবনার স্বপ্নে আবিষ্ট কোনো এক সংবাদপত্রে পড়লাম একটি প্রচণ্ড নেতিবাচক সংবাদ, যার কিয়দংশ সত্য হলেও বুঝতে হবে যে, আমাদের সব অর্জন ও সম্ভাবনা এখনও চোরাবালিতে আটকে আছে। এ দেশের এক-তৃতীয়াংশ জনগোষ্ঠী নাকি দারিদ্র্যসীমার নিচে বাস করে। এর অর্থ এক বিশাল সংখ্যার মানুষ, যার সংখ্যা দাঁড়ায় পাঁচ বা ছয় কোটির মতো, এরা পেটপুরে খেতে পায় না। এরা শিক্ষা ও কর্মসংস্থান থেকে বঞ্চিত। এদের জন্য স্বাস্থ্যসেবা, আবাসন বা বিনোদন কল্পনার বস্তু।
মনে সংশয় জাগে যে, এত সম্ভাবনা ও অর্জন সত্ত্বেও এত মানুষ বঞ্চিত হবে কেন? তাহলে এদের প্রাপ্য অংশ কোথায়, কার হাতে যায়? জানি, যে যখন দেশ শাসন করে সেই ক্ষমতাসীনরা এক প্রকার বিধিপ্রদত্ত নিয়মেই শাসিতদের অংশে ভাগ বসায়। দেশের সব সম্পদেই থাকে তাদের অলিখিত অংশ ও অগ্রাধিকার। তাই বিলিয়ন বিলিয়ন ডলারে রাষ্ট্রীয় কোষাগার স্ফীত হলেও আমাদের প্রশাসন নামক শ্বেতহস্তীর পাওনা তো গুনতেই হবে, যদিও দেশের অর্জনে তাদের দৃশ্যমান কোনো অবদানই নেই।
আরও আছে অনেক পাওনাদার। আছে দলীয় ক্যাডার, আছে ছাত্রলীগের হাতবদল হয়ে অনেক কষ্টে ও স্ফীতোদর; তাদের কাছ থেকে পাওয়া অতি মহার্ঘ টেন্ডার, মন্ত্রী-আমলাদের 'আখের গোছানোর' বিশাল ব্যয়ের বহর। আরও আছে মোসাহেব-চাটুকারদের পাওনা। সরকারকেই বা দোষ দেব কী করে? আমাদের দেশে সরকার পরিচালনার ঝক্কি-ঝামেলা কি কম? মেয়ের বিয়ের আনুষ্ঠানিকতা সামলাতে দরিদ্র পিতার বিপন্ন অবস্থার মতো।
দুঃখ হয়, যে অর্জন বা দেশের সম্পদগুলো ঠিক হাতে কদাচিৎ পেঁৗছতে পারে! তার পরিবর্তে সেগুলো অবধারিতভাবে চলে যায় নষ্টদের হাতে। নষ্টরা তা দিয়ে ভোগবাদে লিপ্ত হয়, ইয়াবা সেবন করে। পচে বখে যায় তাদের চরিত্র-নৈতিকতা। কিন্তু সেই ট্র্যাডিশন কিছুতেই ভাঙা যায় না। আমাদের কোনো প্রতিবাদ বা পর্যবেক্ষণ এমনকি তা সৎ উদ্দেশ্যপ্রণোদিত হলেও ক্ষমতাধরদের দৃষ্টিসীমানা থেকে প্রত্যাখ্যাত হয়। মূল্যায়ন হয় না কোনো মহৎ উদ্দেশ্যেরও। কেননা, এখানে যে সবকিছু চলে গেছে নষ্টদের হাতে।
ব্রিগেডিয়ার (অব.) এম আবদুল হাফিজ সাবেক মহাপরিচালক
বিআইআইএসএস ও কলাম লেখক