॥ এম. আবদুল হাফিজ ॥
সম্প্রতি যুক্তরাষ্ট্র, জাপান ও অস্ট্রেলিয়া দক্ষিণ চীন সমুদ্রে তাদের প্রথম সম্মিলিত নৌমহড়া করেছে গত বছর জুলাইয়ের প্রথম ভাগে। যদিও এই মহড়ায় মাত্র তিনটি নৌপোত অংশ নিয়েছিল। এই ঘটনা একটি বিষয় স্পষ্ট করেছে, তা হলো পূর্ব ও দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার যেসব দেশের সামুদ্রিক বাণিজ্যে আগ্রহ রয়েছে তারা ক্রমবর্ধমানভাবে বল প্রয়োগের উদ্দেশ্য হাসিলের জন্য এবং প্রতিরোধকের ভূমিকায় নৌশক্তি ব্যবহারে ইচ্ছুক। বৃহৎ সামরিক মহড়া, বিশেষ করে চীনের পিপলস লিবারেশন আর্মির নৌশক্তির মহড়া দক্ষিণ চীন সমুদ্রে এখন নিত্যনৈমিত্তিক ব্যাপার। এগুলোর কিছু ঋতুভিত্তিক, আবার কিছু অনুষ্ঠিত হয় নতুন পোত ও সেগুলোর সক্ষমতা পরীক্ষা-নিরীক্ষার জন্য। কিন্তু একই সাথে এসব মহড়ার লক্ষ্য আবার দক্ষিণ ও পূর্ব চীন সমুদ্রে চীনের সার্বভৌমত্ব বহাল রাখা এবং সেখানে কোনো বহিঃশত্রুর অনুপ্রবেশকে ঠেকানো।
চীনের দক্ষিণ চীন সমুদ্রে একটি অ্যান্টিসাবমেরিন মহড়ার এক মাসেরও অল্প সময়ের মধ্যে মার্কিন-জাপান-অস্ট্রেলীয় মহড়াটি অনুষ্ঠিত হয়। তারপরই দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার দেশগুলোর মধ্যে সাবমেরিন ক্রয়ের ধুম পড়ে যায়। মার্কিন বিমানবাহী জাহাজ জর্জ ওয়াশিংটন আগেই অর্থাৎ ২০১০ সালে জাপান সমুদ্রে মোতায়েন হয়েছিল, যদিও সেটি ছিল উত্তর কোরিয়ার মার্কিন মিত্র দেশগুলোতে আক্রমণ পরিচালনার কল্পিত ধারণার প্রতিক্রিয়ায়। তবে যুক্তরাষ্ট্রের বিমানবাহী পোত জাপান সমুদ্রে মোতায়েন ওয়াশিংটনের অভিপ্রায় প্রকাশ্যে ওপরে নিয়ে এসেছিল যে, মার্কিনিরা এতদঞ্চলে তাদের বৈদেশিক নীতির বাস্তবায়নে তাদের নৌশক্তিকে ব্যবহার করবে। উত্তর কোরীয় রণপোত ‘চেওলান’কে ডুবিয়ে দেয়া এই অভিপ্রায়েরই অংশ।
এসব ঘটনাপ্রবাহ আবারো ইউরোপীয় সাম্রাজ্যবাদী শক্তিদের কূটনীতির অস্ত্র হিসেবে তাদের নৌশক্তি ব্যবহারের বিতর্ককে প্রাসঙ্গিক করে তুলেছে। কিন্তু দুই শতাব্দী আগেকার সেই কৌশল আদৌ কি এখন প্রাসঙ্গিকতা খুঁজে পাবে? তারও আগে প্রশ্নÑ গানবোট ডিপ্লোম্যাসির উৎপত্তি কিসে? এবং তা ঘটলে পূর্ব এশিয়ার স্থিতিশীলতায় তার কী প্রভাব পড়বে?
গানবোট ডিপ্লোম্যাসির সারসংক্ষেপ রচিত হয়েছিল ১৮৫০ সালের ডন প্যাসিফিকো ঘটনার মধ্য দিয়ে, যখন ব্রিটিশ রাজকীয় নৌবাহিনী গ্রিক নৌবহরকে লুণ্ঠন করে এবং বন্দরকে অবরুদ্ধ রেখে এক ব্রিটিশ নাগরিক ডন প্যাসিফিকোর বিরুদ্ধে কল্পিত অন্যায়ের ক্ষতিপূরণ দাবি করে। জার্মানরা ১৯১১ সালে গানবোট ‘আগাদির’ পাঠালে মরক্কো সঙ্কটের উদ্ভব ঘটে, যার ফলে ফরাসি কঙ্গো জার্মানদের হাতে চলে যায়। এমন ডিপ্লোম্যাসি এশিয়া প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলের ইতিহাসকেও রূপদান করে। ১৮৫৩ সালে মার্কিন নৌবাহিনীর কমোডর ম্যাথুপেরি চারটি জাহাজ নিয়ে জাপান উপসাগরে হানা দেয়। এই বাহিনীর অগ্রসর প্রযুক্তি এবং কৌশল তৎকালীন শাসক সোগুনদের ভাবতে বাধ্য করে যে আমেরিকানদের জন্য বাণিজ্যের অনুমতি তাদেরকে দিতেই হবে।
১৮৯৩ সালের পাকনাম এপিসডে ফরাসিরা তাদের গানবোট নিয়ে ব্যাংককের অদূরে ‘চাও ফ্রাওয়ারা’ নদীতে হানা দিলে থাই রাজকীয় প্রাসাদ অরক্ষিত হয়ে পড়ে। অতঃপর তারা সিয়াম অবরোধ করলে লাওস ফরাসিদের কাছে প্রত্যর্পণ করা হয়। ১৮৩৯ থেকে ’৪২ সাল পর্যন্ত আফিম যুদ্ধের সম্পূর্ণটাই ছিল চীনে পাশ্চাত্য শক্তিদের ভীতিপ্রদর্শনে চীনের কাছ থেকে বাণিজ্যিক ও অন্যান্য সুবিধা আদায়। ১৯০৮ সালে প্রথমবারের মতো সামরিক শক্তির ছত্রছায়ায় প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলের লুণ্ঠনে আনুষ্ঠানিক অংশ নেয় খোদ যুক্তরাষ্ট্র।
এশিয়া-প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলে গানবোট ডিপ্লোম্যাসির শিকার দেশগুলো পাশ্চাত্যের সাম্রাজ্যবাদীদের কাছ থেকে কালক্রমে এই কৌশল রপ্ত করে। ১৮৭৬ সালে জাপান তার গানবোট হামলা চালায় কোরিয়ার উপকূলবর্তী কিছু কিছু দ্বীপে। সেখান থেকে এরা কতকটা জোরপূর্বক ইনচন, পুসান ইত্যাদি বন্দরে তাদের বাণিজ্যিক ঘাঁটি গড়ে তোলে।
গানবোট ডিপ্লোম্যাসি আমাদের অনেকের কাছে দূর অতীতের বিষয় মনে হলেও এখন আবার তার প্রত্যাবর্তনের আভাস পাওয়া যায়। অতীতে সাম্রাজ্যবাদী পশ্চিমা শক্তিগুলোর সাথে পশ্চাৎপদ এশিয়া-প্রশান্ত সাগরীয় অঞ্চলের দেশগুলোর অনেক পার্থক্য ছিল। তাই সঙ্গত কারণেই এরা গানবোট মহড়ার নীতিতে সাফল্য দেখেছিল। কিন্তু আজকের বিশ্বে এই অসমতা অনেকটাই ঘুচে গেলেও নব্য সাম্রাজ্যবাদীরা এই পুরনো কৌশলের নতুন সংস্করণে এখনো একে কার্যকর করে রেখেছে। কার্যত এশিয়ায় কোনো সময়েই গানবোট ডিপ্লোম্যাসির সম্পূর্ণ পরিসমাপ্তি ঘটেনি। নতুন নতুন আঙ্গিকে তা একই বা নতুন নতুন দেশে প্রয়োগ করা হচ্ছে।
যদিও গানবোট ডিপ্লোম্যাসি পূর্ব এশীয় সমুদ্র থেকে কালেভদ্রে অন্তর্হিত হয়েছে, এ অঞ্চলে এই কৌশলের পুনরাবির্ভাব সমুদ্রের দখল সম্পর্কিত বিবাদে নতুন মাত্রা যোগ করেছে। এর সবচেয়ে বৃহৎ নজির জাপান সমুদ্রে বিমানবাহী রণপোত জর্জ ওয়াশিংটনের উপস্থিতি এবং ২০১০ সালে একই অঞ্চলে Invincible Spirit' শিরোনামের সামরিক মহড়া। এই একই রণপোত একই বছরের মার্চ মাসে দক্ষিণ কোরিয়ার সাথে যৌথ মহড়ায় পীত সাগরে (yellow sea) ব্যবহার হয়েছিল। উত্তর কোরীয় জাহাজ ‘চেওমান’কে ঘায়েল করার সম্ভাব্য উত্তর কোরীয় প্রত্যাঘাতকে সামাল দিতে এই যৌথ মহড়া অনুষ্ঠিত হয়েছিল। এই মহড়ায় জর্জ ওয়াশিংটনের সাথে ছিল দু’টি ক্রুজার ও দু’টি ডেস্ট্রয়ার। চীনের তীব্র সমালোচনার তোয়াক্কা করেনি মার্কিনিরা এবং তাদের মিত্ররা।
কিন্তু এ ধরনের গানবোট ডিপ্লোম্যাসিতে শুধু যুক্তরাষ্ট্রই নয়, ক্রমবর্ধমান এই প্রবণতার সাথে তাল মিলিয়ে চীনও এখন এই খেলায় মেতেছে। শুধু ২০১১ সালেই পিএলএর নৌশাখা ছয়-ছয়টি মহড়া করেছে। চীনের প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়ের মুখপাত্রকে বাধ্য করেছে এ কথা অস্বীকার করতে যে, মহড়াগুলো মূলত ছিল দক্ষিণ চীন সমুদ্রে আধিপত্য বিস্তারের বিবাদ সম্পর্কিত। ২০১০ সালে জুলাইয়ের শেষ ভাগে চীনা নৌবাহিনীর এ যাবৎকালের বৃহত্তম মহড়াটি হয়েছিল, যাতে চীন লাইভ ফায়ারের (Live Fire) ঝুঁকি নিয়েছিল। চীনের রাষ্ট্রীয় টেলিভিশনে পিএলএর চিফ অব স্টাফ চেন বিং এই মহড়া চলার সময় এর প্রতিক্রিয়া জানতে চীনাদের নিবিড় পর্যবেক্ষণের কথা এবং প্রয়োজনে যুদ্ধকালীন প্রস্তুতির কথাও বলেছেন। উল্লেখ্য, এই গুরুত্বপূর্ণ মহড়াটি অনুষ্ঠিত হয় হিলারি কিনটনের দণি চীন সমুদ্রে নৌচলাচলের স্বাধীনতার ঘোষণা দেয়ার মাত্র এক সপ্তাহ পর।
চীন এখন কোনো রাখঢাক না করে রাষ্ট্র নিয়ন্ত্রিত মিডিয়ার বৈরী মন্তব্যে যুক্তরাষ্ট্রসহ সম্ভাব্য প্রতিপক্ষকে কটাক্ষ করতে ছাড়ছে না। সিনহুয়া পরিবেশিত পিপলস ডেইলিতে প্রকাশিত খবরে বলা হয়েছে, চীনা নেতৃত্ব প্রতিপক্ষের রণতরীকে ধ্বংস করার ক্ষমতায় প্রত্যয়ী ও দৃঢ়সঙ্কল্প। চীন আরো বলেছে, কেউ যেন চীনা সঙ্কল্পের অবমূল্যায়ন না করে যে তা তার ভৌগোলিক সীমার প্রতি ইঞ্চি সংরক্ষণ করবে এবং এর অন্তর্ভুক্ত দক্ষিণ চীন সমুদ্র।
লেখক : অবসরপ্রাপ্ত ব্রিগেডিয়ার এবং নিরাপত্তা, রাজনীতি, বৈদেশিক নীতি ও আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিশ্লেষক
সম্প্রতি যুক্তরাষ্ট্র, জাপান ও অস্ট্রেলিয়া দক্ষিণ চীন সমুদ্রে তাদের প্রথম সম্মিলিত নৌমহড়া করেছে গত বছর জুলাইয়ের প্রথম ভাগে। যদিও এই মহড়ায় মাত্র তিনটি নৌপোত অংশ নিয়েছিল। এই ঘটনা একটি বিষয় স্পষ্ট করেছে, তা হলো পূর্ব ও দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার যেসব দেশের সামুদ্রিক বাণিজ্যে আগ্রহ রয়েছে তারা ক্রমবর্ধমানভাবে বল প্রয়োগের উদ্দেশ্য হাসিলের জন্য এবং প্রতিরোধকের ভূমিকায় নৌশক্তি ব্যবহারে ইচ্ছুক। বৃহৎ সামরিক মহড়া, বিশেষ করে চীনের পিপলস লিবারেশন আর্মির নৌশক্তির মহড়া দক্ষিণ চীন সমুদ্রে এখন নিত্যনৈমিত্তিক ব্যাপার। এগুলোর কিছু ঋতুভিত্তিক, আবার কিছু অনুষ্ঠিত হয় নতুন পোত ও সেগুলোর সক্ষমতা পরীক্ষা-নিরীক্ষার জন্য। কিন্তু একই সাথে এসব মহড়ার লক্ষ্য আবার দক্ষিণ ও পূর্ব চীন সমুদ্রে চীনের সার্বভৌমত্ব বহাল রাখা এবং সেখানে কোনো বহিঃশত্রুর অনুপ্রবেশকে ঠেকানো।
চীনের দক্ষিণ চীন সমুদ্রে একটি অ্যান্টিসাবমেরিন মহড়ার এক মাসেরও অল্প সময়ের মধ্যে মার্কিন-জাপান-অস্ট্রেলীয় মহড়াটি অনুষ্ঠিত হয়। তারপরই দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার দেশগুলোর মধ্যে সাবমেরিন ক্রয়ের ধুম পড়ে যায়। মার্কিন বিমানবাহী জাহাজ জর্জ ওয়াশিংটন আগেই অর্থাৎ ২০১০ সালে জাপান সমুদ্রে মোতায়েন হয়েছিল, যদিও সেটি ছিল উত্তর কোরিয়ার মার্কিন মিত্র দেশগুলোতে আক্রমণ পরিচালনার কল্পিত ধারণার প্রতিক্রিয়ায়। তবে যুক্তরাষ্ট্রের বিমানবাহী পোত জাপান সমুদ্রে মোতায়েন ওয়াশিংটনের অভিপ্রায় প্রকাশ্যে ওপরে নিয়ে এসেছিল যে, মার্কিনিরা এতদঞ্চলে তাদের বৈদেশিক নীতির বাস্তবায়নে তাদের নৌশক্তিকে ব্যবহার করবে। উত্তর কোরীয় রণপোত ‘চেওলান’কে ডুবিয়ে দেয়া এই অভিপ্রায়েরই অংশ।
এসব ঘটনাপ্রবাহ আবারো ইউরোপীয় সাম্রাজ্যবাদী শক্তিদের কূটনীতির অস্ত্র হিসেবে তাদের নৌশক্তি ব্যবহারের বিতর্ককে প্রাসঙ্গিক করে তুলেছে। কিন্তু দুই শতাব্দী আগেকার সেই কৌশল আদৌ কি এখন প্রাসঙ্গিকতা খুঁজে পাবে? তারও আগে প্রশ্নÑ গানবোট ডিপ্লোম্যাসির উৎপত্তি কিসে? এবং তা ঘটলে পূর্ব এশিয়ার স্থিতিশীলতায় তার কী প্রভাব পড়বে?
গানবোট ডিপ্লোম্যাসির সারসংক্ষেপ রচিত হয়েছিল ১৮৫০ সালের ডন প্যাসিফিকো ঘটনার মধ্য দিয়ে, যখন ব্রিটিশ রাজকীয় নৌবাহিনী গ্রিক নৌবহরকে লুণ্ঠন করে এবং বন্দরকে অবরুদ্ধ রেখে এক ব্রিটিশ নাগরিক ডন প্যাসিফিকোর বিরুদ্ধে কল্পিত অন্যায়ের ক্ষতিপূরণ দাবি করে। জার্মানরা ১৯১১ সালে গানবোট ‘আগাদির’ পাঠালে মরক্কো সঙ্কটের উদ্ভব ঘটে, যার ফলে ফরাসি কঙ্গো জার্মানদের হাতে চলে যায়। এমন ডিপ্লোম্যাসি এশিয়া প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলের ইতিহাসকেও রূপদান করে। ১৮৫৩ সালে মার্কিন নৌবাহিনীর কমোডর ম্যাথুপেরি চারটি জাহাজ নিয়ে জাপান উপসাগরে হানা দেয়। এই বাহিনীর অগ্রসর প্রযুক্তি এবং কৌশল তৎকালীন শাসক সোগুনদের ভাবতে বাধ্য করে যে আমেরিকানদের জন্য বাণিজ্যের অনুমতি তাদেরকে দিতেই হবে।
১৮৯৩ সালের পাকনাম এপিসডে ফরাসিরা তাদের গানবোট নিয়ে ব্যাংককের অদূরে ‘চাও ফ্রাওয়ারা’ নদীতে হানা দিলে থাই রাজকীয় প্রাসাদ অরক্ষিত হয়ে পড়ে। অতঃপর তারা সিয়াম অবরোধ করলে লাওস ফরাসিদের কাছে প্রত্যর্পণ করা হয়। ১৮৩৯ থেকে ’৪২ সাল পর্যন্ত আফিম যুদ্ধের সম্পূর্ণটাই ছিল চীনে পাশ্চাত্য শক্তিদের ভীতিপ্রদর্শনে চীনের কাছ থেকে বাণিজ্যিক ও অন্যান্য সুবিধা আদায়। ১৯০৮ সালে প্রথমবারের মতো সামরিক শক্তির ছত্রছায়ায় প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলের লুণ্ঠনে আনুষ্ঠানিক অংশ নেয় খোদ যুক্তরাষ্ট্র।
এশিয়া-প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলে গানবোট ডিপ্লোম্যাসির শিকার দেশগুলো পাশ্চাত্যের সাম্রাজ্যবাদীদের কাছ থেকে কালক্রমে এই কৌশল রপ্ত করে। ১৮৭৬ সালে জাপান তার গানবোট হামলা চালায় কোরিয়ার উপকূলবর্তী কিছু কিছু দ্বীপে। সেখান থেকে এরা কতকটা জোরপূর্বক ইনচন, পুসান ইত্যাদি বন্দরে তাদের বাণিজ্যিক ঘাঁটি গড়ে তোলে।
গানবোট ডিপ্লোম্যাসি আমাদের অনেকের কাছে দূর অতীতের বিষয় মনে হলেও এখন আবার তার প্রত্যাবর্তনের আভাস পাওয়া যায়। অতীতে সাম্রাজ্যবাদী পশ্চিমা শক্তিগুলোর সাথে পশ্চাৎপদ এশিয়া-প্রশান্ত সাগরীয় অঞ্চলের দেশগুলোর অনেক পার্থক্য ছিল। তাই সঙ্গত কারণেই এরা গানবোট মহড়ার নীতিতে সাফল্য দেখেছিল। কিন্তু আজকের বিশ্বে এই অসমতা অনেকটাই ঘুচে গেলেও নব্য সাম্রাজ্যবাদীরা এই পুরনো কৌশলের নতুন সংস্করণে এখনো একে কার্যকর করে রেখেছে। কার্যত এশিয়ায় কোনো সময়েই গানবোট ডিপ্লোম্যাসির সম্পূর্ণ পরিসমাপ্তি ঘটেনি। নতুন নতুন আঙ্গিকে তা একই বা নতুন নতুন দেশে প্রয়োগ করা হচ্ছে।
যদিও গানবোট ডিপ্লোম্যাসি পূর্ব এশীয় সমুদ্র থেকে কালেভদ্রে অন্তর্হিত হয়েছে, এ অঞ্চলে এই কৌশলের পুনরাবির্ভাব সমুদ্রের দখল সম্পর্কিত বিবাদে নতুন মাত্রা যোগ করেছে। এর সবচেয়ে বৃহৎ নজির জাপান সমুদ্রে বিমানবাহী রণপোত জর্জ ওয়াশিংটনের উপস্থিতি এবং ২০১০ সালে একই অঞ্চলে Invincible Spirit' শিরোনামের সামরিক মহড়া। এই একই রণপোত একই বছরের মার্চ মাসে দক্ষিণ কোরিয়ার সাথে যৌথ মহড়ায় পীত সাগরে (yellow sea) ব্যবহার হয়েছিল। উত্তর কোরীয় জাহাজ ‘চেওমান’কে ঘায়েল করার সম্ভাব্য উত্তর কোরীয় প্রত্যাঘাতকে সামাল দিতে এই যৌথ মহড়া অনুষ্ঠিত হয়েছিল। এই মহড়ায় জর্জ ওয়াশিংটনের সাথে ছিল দু’টি ক্রুজার ও দু’টি ডেস্ট্রয়ার। চীনের তীব্র সমালোচনার তোয়াক্কা করেনি মার্কিনিরা এবং তাদের মিত্ররা।
কিন্তু এ ধরনের গানবোট ডিপ্লোম্যাসিতে শুধু যুক্তরাষ্ট্রই নয়, ক্রমবর্ধমান এই প্রবণতার সাথে তাল মিলিয়ে চীনও এখন এই খেলায় মেতেছে। শুধু ২০১১ সালেই পিএলএর নৌশাখা ছয়-ছয়টি মহড়া করেছে। চীনের প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়ের মুখপাত্রকে বাধ্য করেছে এ কথা অস্বীকার করতে যে, মহড়াগুলো মূলত ছিল দক্ষিণ চীন সমুদ্রে আধিপত্য বিস্তারের বিবাদ সম্পর্কিত। ২০১০ সালে জুলাইয়ের শেষ ভাগে চীনা নৌবাহিনীর এ যাবৎকালের বৃহত্তম মহড়াটি হয়েছিল, যাতে চীন লাইভ ফায়ারের (Live Fire) ঝুঁকি নিয়েছিল। চীনের রাষ্ট্রীয় টেলিভিশনে পিএলএর চিফ অব স্টাফ চেন বিং এই মহড়া চলার সময় এর প্রতিক্রিয়া জানতে চীনাদের নিবিড় পর্যবেক্ষণের কথা এবং প্রয়োজনে যুদ্ধকালীন প্রস্তুতির কথাও বলেছেন। উল্লেখ্য, এই গুরুত্বপূর্ণ মহড়াটি অনুষ্ঠিত হয় হিলারি কিনটনের দণি চীন সমুদ্রে নৌচলাচলের স্বাধীনতার ঘোষণা দেয়ার মাত্র এক সপ্তাহ পর।
চীন এখন কোনো রাখঢাক না করে রাষ্ট্র নিয়ন্ত্রিত মিডিয়ার বৈরী মন্তব্যে যুক্তরাষ্ট্রসহ সম্ভাব্য প্রতিপক্ষকে কটাক্ষ করতে ছাড়ছে না। সিনহুয়া পরিবেশিত পিপলস ডেইলিতে প্রকাশিত খবরে বলা হয়েছে, চীনা নেতৃত্ব প্রতিপক্ষের রণতরীকে ধ্বংস করার ক্ষমতায় প্রত্যয়ী ও দৃঢ়সঙ্কল্প। চীন আরো বলেছে, কেউ যেন চীনা সঙ্কল্পের অবমূল্যায়ন না করে যে তা তার ভৌগোলিক সীমার প্রতি ইঞ্চি সংরক্ষণ করবে এবং এর অন্তর্ভুক্ত দক্ষিণ চীন সমুদ্র।
লেখক : অবসরপ্রাপ্ত ব্রিগেডিয়ার এবং নিরাপত্তা, রাজনীতি, বৈদেশিক নীতি ও আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিশ্লেষক
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন