রবিবার, ১০ ফেব্রুয়ারী, ২০১৩

সবকিছু চলে গেছে নষ্টদের হাতে



এম আবদুল হাফিজ
স্বদেশের কোনো 'সাকসেস স্টোরি' শুনতে কার না ভালো লাগে! টিভির পর্দা এবং সংবাদপত্রের পৃষ্ঠায় সেসব সফলতার কথা আমরা অহরহ শুনছি ও দেখছি। যে কোনো ভূখণ্ডের স্বাধীন সত্তাই সাফল্যের মহাসড়কে তুলে দেয় একটি জাতিকে। এক সময় আমাদের পরিসর ছিল বড়জোর করাচি-লাহোর পর্যন্ত বিস্তৃত। আমাদের দুর্দমনীয় তরুণদের জন্য সামনে এগোনোয় কোনো সীমারেখা নেই আজ। শুধু কর্মজীবী অভিবাসীই নাকি আমাদের রয়েছে এক কোটির মতো, যারা বছরে ১৪ বিলিয়ন ডলারের মতো রেমিট্যান্স পাঠায় রাষ্ট্রীয় কোষাগারে। কেউ কি কখনও এই পরিমাণ রেমিট্যান্সের কথা ভাবতে পেরেছিল! অথচ তাদের অভিবাসনের জন্য রাষ্ট্রের আদৌ কোনো অবদান থেকে থাকলেও তা সামান্যই।
কী করে সারাবিশ্বের সঙ্গে প্রতিযোগিতা করে তারা নিজ নিজ কর্মস্থলে টিকে আছে! ওই একটি মন্ত্র স্বাধীনতার স্বপ্নবীজ তাদের সেই প্রতিযোগিতায় উজ্জীবনী শক্তি দিয়েছে। যদিও তাদের অভিবাসনের প্রক্রিয়া অবশ্যই কুসুমাস্তীর্ণ হয়নি। আমাদেরই জনশক্তি দালালরা তাদের পদে পদে প্রতারণা করেছে, এগোনোর পথে হোঁচট খাইয়েছে। আজ যখন প্রধানমন্ত্রী বিশ্বব্যাংককে 'না' করে দিয়ে নিজস্ব অর্থায়নে পদ্মা সেতু নির্মাণের কথা বলেন, তার নেপথ্য শক্তি ওইসব নাম-পরিচয়হীন, খেটে খাওয়া মানুষ; এ দেশের কোনো বিড়লা বা টাটারা নয়।
এই শক্তির আরও উৎস আমাদের কৃষককুল, যারা একটুখানি প্রণোদনা পেলে একই মাটি থেকে অন্তত তিনগুণ অধিক ফসল ফলাতে সক্ষম। ১৯৭২-এ বাংলাদেশের বিপুল খাদ্য ঘাটতি ছিল, যা সদ্যস্বাধীন দেশটি উত্তরাধিকারসূত্রেই সংযুক্ত পাকিস্তান থেকে পেয়েছিল। আজ ওই মাটি থেকেই খাদ্য উৎপাদন করে প্রয়োজনীয় আরও কয়েখ লাখ টন খাদ্য আমদানি থেকে অব্যাহতি দিয়ে আমাদের কৃষকরা অনেক ত্যাগ-তিতিক্ষায় অর্জিত স্বাধীনতার প্রতি দায়বদ্ধতা থেকে নিজেদের মুক্ত করেছেন।
স্বাধীনতা এক অমূল্য সঞ্জীবনী শক্তি, যার স্পর্শে আমাদের ছেলেমেয়েরা অবলীলায় এভারেস্টের চূড়ায় ওঠে। ক্ষেতে-খামারে খাটে। দায়িত্বশীল পদ অলঙ্কৃত করে। এ সবকিছুই সম্ভব হয়েছে স্বাধীনতার কারণে, যেখানে যোগ্যতা থাকলে যে কোনো প্রতিবন্ধকতা উতরানো যায়। আমাদের নারী কর্মজীবীরা মানবসম্পদ সূচকে এই অঞ্চলে একটি ঈর্ষণীয় অবস্থান দখল করে আছে। অজপাড়াগাঁর ছমিরন-করিমনরা আজ পরনির্ভর না থেকে খানিকটা স্বাচ্ছন্দ্যের খোঁজে সূচিশিল্পে যোগ দিয়ে বিপুল পরিমাণ বৈদেশিক মুদ্রার সংস্থান করেছে আমাদের তৈরি পোশাকের বাজারে। শোনা যায়, বিশ্ব গার্মেন্ট বাজারে এদেরই একাধিপত্য ভাঙতে বড় বড় প্রতিযোগী মাঠে নেমেও সাফল্য কুড়োতে পারেনি।
একটি প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর দেশে আমরা যে একেবারে খারাপ নেই বা আমরা যে নেহাত ব্যর্থ নই_ দেশটির চেহারা দেখলেও কি তা বিশ্বাস হয় না? আজ এ দেশে কাজের বুয়ারাও সেলফোন ব্যবহার করে। নিম্ন বেতনভোগী মেয়েরাও জিন্স পরে। আমি আমার বসবাসের এলাকায় ঠিকা ঝিদেরও নগ্ন পায়ে দেখি না। একটি সাফল্যের চিত্র আমাদের মতো দেশেও সুদূরপরাহত নয়। প্রান্তিক জনগণও এখন আশাবাদী এবং তারা কষ্ট-দারিদ্র্যের মধ্যে থেকেও সে আশাবাদ পোষণ করে এবং নগদ নগদ জীবনকে উপভোগ করতে চায়। সরকারি আনুকূল্যের অযথা প্রতীক্ষায় না থেকে তারা নিজেরাই তাদের সমস্যার জট খুলতে চেষ্টা করে। এটাই হলো এ দেশের ইতিবাচক দিক এবং সাফল্যের চালিকাশক্তি।
তবে হরিষে বিষাদও আছে। যখন দেশের অমিত সম্ভাবনার স্বপ্নে আবিষ্ট কোনো এক সংবাদপত্রে পড়লাম একটি প্রচণ্ড নেতিবাচক সংবাদ, যার কিয়দংশ সত্য হলেও বুঝতে হবে যে, আমাদের সব অর্জন ও সম্ভাবনা এখনও চোরাবালিতে আটকে আছে। এ দেশের এক-তৃতীয়াংশ জনগোষ্ঠী নাকি দারিদ্র্যসীমার নিচে বাস করে। এর অর্থ এক বিশাল সংখ্যার মানুষ, যার সংখ্যা দাঁড়ায় পাঁচ বা ছয় কোটির মতো, এরা পেটপুরে খেতে পায় না। এরা শিক্ষা ও কর্মসংস্থান থেকে বঞ্চিত। এদের জন্য স্বাস্থ্যসেবা, আবাসন বা বিনোদন কল্পনার বস্তু।
মনে সংশয় জাগে যে, এত সম্ভাবনা ও অর্জন সত্ত্বেও এত মানুষ বঞ্চিত হবে কেন? তাহলে এদের প্রাপ্য অংশ কোথায়, কার হাতে যায়? জানি, যে যখন দেশ শাসন করে সেই ক্ষমতাসীনরা এক প্রকার বিধিপ্রদত্ত নিয়মেই শাসিতদের অংশে ভাগ বসায়। দেশের সব সম্পদেই থাকে তাদের অলিখিত অংশ ও অগ্রাধিকার। তাই বিলিয়ন বিলিয়ন ডলারে রাষ্ট্রীয় কোষাগার স্ফীত হলেও আমাদের প্রশাসন নামক শ্বেতহস্তীর পাওনা তো গুনতেই হবে, যদিও দেশের অর্জনে তাদের দৃশ্যমান কোনো অবদানই নেই।
আরও আছে অনেক পাওনাদার। আছে দলীয় ক্যাডার, আছে ছাত্রলীগের হাতবদল হয়ে অনেক কষ্টে ও স্ফীতোদর; তাদের কাছ থেকে পাওয়া অতি মহার্ঘ টেন্ডার, মন্ত্রী-আমলাদের 'আখের গোছানোর' বিশাল ব্যয়ের বহর। আরও আছে মোসাহেব-চাটুকারদের পাওনা। সরকারকেই বা দোষ দেব কী করে? আমাদের দেশে সরকার পরিচালনার ঝক্কি-ঝামেলা কি কম? মেয়ের বিয়ের আনুষ্ঠানিকতা সামলাতে দরিদ্র পিতার বিপন্ন অবস্থার মতো।
দুঃখ হয়, যে অর্জন বা দেশের সম্পদগুলো ঠিক হাতে কদাচিৎ পেঁৗছতে পারে! তার পরিবর্তে সেগুলো অবধারিতভাবে চলে যায় নষ্টদের হাতে। নষ্টরা তা দিয়ে ভোগবাদে লিপ্ত হয়, ইয়াবা সেবন করে। পচে বখে যায় তাদের চরিত্র-নৈতিকতা। কিন্তু সেই ট্র্যাডিশন কিছুতেই ভাঙা যায় না। আমাদের কোনো প্রতিবাদ বা পর্যবেক্ষণ এমনকি তা সৎ উদ্দেশ্যপ্রণোদিত হলেও ক্ষমতাধরদের দৃষ্টিসীমানা থেকে প্রত্যাখ্যাত হয়। মূল্যায়ন হয় না কোনো মহৎ উদ্দেশ্যেরও। কেননা, এখানে যে সবকিছু চলে গেছে নষ্টদের হাতে।

ব্রিগেডিয়ার (অব.) এম আবদুল হাফিজ সাবেক মহাপরিচালক
বিআইআইএসএস ও কলাম লেখক

রবিবার, ১ জুলাই, ২০১২

‘গানবোট ডিপ্লোম্যাসি’র প্রত্যাবর্তন?

‘গানবোট ডিপ্লোম্যাসি’র প্রত্যাবর্তন?



॥ এম. আবদুল হাফিজ ॥

সম্প্রতি যুক্তরাষ্ট্র, জাপান ও অস্ট্রেলিয়া দক্ষিণ চীন সমুদ্রে তাদের প্রথম সম্মিলিত নৌমহড়া করেছে গত বছর জুলাইয়ের প্রথম ভাগে। যদিও এই মহড়ায় মাত্র তিনটি নৌপোত অংশ নিয়েছিল। এই ঘটনা একটি বিষয় স্পষ্ট করেছে, তা হলো পূর্ব ও দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার যেসব দেশের সামুদ্রিক বাণিজ্যে আগ্রহ রয়েছে তারা ক্রমবর্ধমানভাবে বল প্রয়োগের উদ্দেশ্য হাসিলের জন্য এবং প্রতিরোধকের ভূমিকায় নৌশক্তি ব্যবহারে ইচ্ছুক। বৃহৎ সামরিক মহড়া, বিশেষ করে চীনের পিপলস লিবারেশন আর্মির নৌশক্তির মহড়া দক্ষিণ চীন সমুদ্রে এখন নিত্যনৈমিত্তিক ব্যাপার। এগুলোর কিছু ঋতুভিত্তিক, আবার কিছু অনুষ্ঠিত হয় নতুন পোত ও সেগুলোর সক্ষমতা পরীক্ষা-নিরীক্ষার জন্য। কিন্তু একই সাথে এসব মহড়ার লক্ষ্য আবার দক্ষিণ ও পূর্ব চীন সমুদ্রে চীনের সার্বভৌমত্ব বহাল রাখা এবং সেখানে কোনো বহিঃশত্রুর অনুপ্রবেশকে ঠেকানো। 
চীনের দক্ষিণ চীন সমুদ্রে একটি অ্যান্টিসাবমেরিন মহড়ার এক মাসেরও অল্প সময়ের মধ্যে মার্কিন-জাপান-অস্ট্রেলীয় মহড়াটি অনুষ্ঠিত হয়। তারপরই দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার দেশগুলোর মধ্যে সাবমেরিন ক্রয়ের ধুম পড়ে যায়। মার্কিন বিমানবাহী জাহাজ জর্জ ওয়াশিংটন আগেই অর্থাৎ ২০১০ সালে জাপান সমুদ্রে মোতায়েন হয়েছিল, যদিও সেটি ছিল উত্তর কোরিয়ার মার্কিন মিত্র দেশগুলোতে আক্রমণ পরিচালনার কল্পিত ধারণার প্রতিক্রিয়ায়। তবে যুক্তরাষ্ট্রের বিমানবাহী পোত জাপান সমুদ্রে মোতায়েন ওয়াশিংটনের অভিপ্রায় প্রকাশ্যে ওপরে নিয়ে এসেছিল যে, মার্কিনিরা এতদঞ্চলে তাদের বৈদেশিক নীতির বাস্তবায়নে তাদের নৌশক্তিকে ব্যবহার করবে। উত্তর কোরীয় রণপোত ‘চেওলান’কে ডুবিয়ে দেয়া এই অভিপ্রায়েরই অংশ। 
এসব ঘটনাপ্রবাহ আবারো ইউরোপীয় সাম্রাজ্যবাদী শক্তিদের কূটনীতির অস্ত্র হিসেবে তাদের নৌশক্তি ব্যবহারের বিতর্ককে প্রাসঙ্গিক করে তুলেছে। কিন্তু দুই শতাব্দী আগেকার সেই কৌশল আদৌ কি এখন প্রাসঙ্গিকতা খুঁজে পাবে? তারও আগে প্রশ্নÑ গানবোট ডিপ্লোম্যাসির উৎপত্তি কিসে? এবং তা ঘটলে পূর্ব এশিয়ার স্থিতিশীলতায় তার কী প্রভাব পড়বে?
গানবোট ডিপ্লোম্যাসির সারসংক্ষেপ রচিত হয়েছিল ১৮৫০ সালের ডন প্যাসিফিকো ঘটনার মধ্য দিয়ে, যখন ব্রিটিশ রাজকীয় নৌবাহিনী গ্রিক নৌবহরকে লুণ্ঠন করে এবং বন্দরকে অবরুদ্ধ রেখে এক ব্রিটিশ নাগরিক ডন প্যাসিফিকোর বিরুদ্ধে কল্পিত অন্যায়ের ক্ষতিপূরণ দাবি করে। জার্মানরা ১৯১১ সালে গানবোট ‘আগাদির’ পাঠালে মরক্কো সঙ্কটের উদ্ভব ঘটে, যার ফলে ফরাসি কঙ্গো জার্মানদের হাতে চলে যায়। এমন ডিপ্লোম্যাসি এশিয়া প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলের ইতিহাসকেও রূপদান করে। ১৮৫৩ সালে মার্কিন নৌবাহিনীর কমোডর ম্যাথুপেরি চারটি জাহাজ নিয়ে জাপান উপসাগরে হানা দেয়। এই বাহিনীর অগ্রসর প্রযুক্তি এবং কৌশল তৎকালীন শাসক সোগুনদের ভাবতে বাধ্য করে যে আমেরিকানদের জন্য বাণিজ্যের অনুমতি তাদেরকে দিতেই হবে। 
১৮৯৩ সালের পাকনাম এপিসডে ফরাসিরা তাদের গানবোট নিয়ে ব্যাংককের অদূরে ‘চাও ফ্রাওয়ারা’ নদীতে হানা দিলে থাই রাজকীয় প্রাসাদ অরক্ষিত হয়ে পড়ে। অতঃপর তারা সিয়াম অবরোধ করলে লাওস ফরাসিদের কাছে প্রত্যর্পণ করা হয়। ১৮৩৯ থেকে ’৪২ সাল পর্যন্ত আফিম যুদ্ধের সম্পূর্ণটাই ছিল চীনে পাশ্চাত্য শক্তিদের ভীতিপ্রদর্শনে চীনের কাছ থেকে বাণিজ্যিক ও অন্যান্য সুবিধা আদায়। ১৯০৮ সালে প্রথমবারের মতো সামরিক শক্তির ছত্রছায়ায় প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলের লুণ্ঠনে আনুষ্ঠানিক অংশ নেয় খোদ যুক্তরাষ্ট্র।
এশিয়া-প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলে গানবোট ডিপ্লোম্যাসির শিকার দেশগুলো পাশ্চাত্যের সাম্রাজ্যবাদীদের কাছ থেকে কালক্রমে এই কৌশল রপ্ত করে। ১৮৭৬ সালে জাপান তার গানবোট হামলা চালায় কোরিয়ার উপকূলবর্তী কিছু কিছু দ্বীপে। সেখান থেকে এরা কতকটা জোরপূর্বক ইনচন, পুসান ইত্যাদি বন্দরে তাদের বাণিজ্যিক ঘাঁটি গড়ে তোলে। 
গানবোট ডিপ্লোম্যাসি আমাদের অনেকের কাছে দূর অতীতের বিষয় মনে হলেও এখন আবার তার প্রত্যাবর্তনের আভাস পাওয়া যায়। অতীতে সাম্রাজ্যবাদী পশ্চিমা শক্তিগুলোর সাথে পশ্চাৎপদ এশিয়া-প্রশান্ত সাগরীয় অঞ্চলের দেশগুলোর অনেক পার্থক্য ছিল। তাই সঙ্গত কারণেই এরা গানবোট মহড়ার নীতিতে সাফল্য দেখেছিল। কিন্তু আজকের বিশ্বে এই অসমতা অনেকটাই ঘুচে গেলেও নব্য সাম্রাজ্যবাদীরা এই পুরনো কৌশলের নতুন সংস্করণে এখনো একে কার্যকর করে রেখেছে। কার্যত এশিয়ায় কোনো সময়েই গানবোট ডিপ্লোম্যাসির সম্পূর্ণ পরিসমাপ্তি ঘটেনি। নতুন নতুন আঙ্গিকে তা একই বা নতুন নতুন দেশে প্রয়োগ করা হচ্ছে।
যদিও গানবোট ডিপ্লোম্যাসি পূর্ব এশীয় সমুদ্র থেকে কালেভদ্রে অন্তর্হিত হয়েছে, এ অঞ্চলে এই কৌশলের পুনরাবির্ভাব সমুদ্রের দখল সম্পর্কিত বিবাদে নতুন মাত্রা যোগ করেছে। এর সবচেয়ে বৃহৎ নজির জাপান সমুদ্রে বিমানবাহী রণপোত জর্জ ওয়াশিংটনের উপস্থিতি এবং ২০১০ সালে একই অঞ্চলে Invincible Spirit' শিরোনামের সামরিক মহড়া। এই একই রণপোত একই বছরের মার্চ মাসে দক্ষিণ কোরিয়ার সাথে যৌথ মহড়ায় পীত সাগরে (yellow sea) ব্যবহার হয়েছিল। উত্তর কোরীয় জাহাজ ‘চেওমান’কে ঘায়েল করার সম্ভাব্য উত্তর কোরীয় প্রত্যাঘাতকে সামাল দিতে এই যৌথ মহড়া অনুষ্ঠিত হয়েছিল। এই মহড়ায় জর্জ ওয়াশিংটনের সাথে ছিল দু’টি ক্রুজার ও দু’টি ডেস্ট্রয়ার। চীনের তীব্র সমালোচনার তোয়াক্কা করেনি মার্কিনিরা এবং তাদের মিত্ররা।
কিন্তু এ ধরনের গানবোট ডিপ্লোম্যাসিতে শুধু যুক্তরাষ্ট্রই নয়, ক্রমবর্ধমান এই প্রবণতার সাথে তাল মিলিয়ে চীনও এখন এই খেলায় মেতেছে। শুধু ২০১১ সালেই পিএলএর নৌশাখা ছয়-ছয়টি মহড়া করেছে। চীনের প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়ের মুখপাত্রকে বাধ্য করেছে এ কথা অস্বীকার করতে যে, মহড়াগুলো মূলত ছিল দক্ষিণ চীন সমুদ্রে আধিপত্য বিস্তারের বিবাদ সম্পর্কিত। ২০১০ সালে জুলাইয়ের শেষ ভাগে চীনা নৌবাহিনীর এ যাবৎকালের বৃহত্তম মহড়াটি হয়েছিল, যাতে চীন লাইভ ফায়ারের (Live Fire) ঝুঁকি নিয়েছিল। চীনের রাষ্ট্রীয় টেলিভিশনে পিএলএর চিফ অব স্টাফ চেন বিং এই মহড়া চলার সময় এর প্রতিক্রিয়া জানতে চীনাদের নিবিড় পর্যবেক্ষণের কথা এবং প্রয়োজনে যুদ্ধকালীন প্রস্তুতির কথাও বলেছেন। উল্লেখ্য, এই গুরুত্বপূর্ণ মহড়াটি অনুষ্ঠিত হয় হিলারি কিনটনের দণি চীন সমুদ্রে নৌচলাচলের স্বাধীনতার ঘোষণা দেয়ার মাত্র এক সপ্তাহ পর।
চীন এখন কোনো রাখঢাক না করে রাষ্ট্র নিয়ন্ত্রিত মিডিয়ার বৈরী মন্তব্যে যুক্তরাষ্ট্রসহ সম্ভাব্য প্রতিপক্ষকে কটাক্ষ করতে ছাড়ছে না। সিনহুয়া পরিবেশিত পিপলস ডেইলিতে প্রকাশিত খবরে বলা হয়েছে, চীনা নেতৃত্ব প্রতিপক্ষের রণতরীকে ধ্বংস করার ক্ষমতায় প্রত্যয়ী ও দৃঢ়সঙ্কল্প। চীন আরো বলেছে, কেউ যেন চীনা সঙ্কল্পের অবমূল্যায়ন না করে যে তা তার ভৌগোলিক সীমার প্রতি ইঞ্চি সংরক্ষণ করবে এবং এর অন্তর্ভুক্ত দক্ষিণ চীন সমুদ্র। 
লেখক : অবসরপ্রাপ্ত ব্রিগেডিয়ার এবং নিরাপত্তা, রাজনীতি, বৈদেশিক নীতি ও আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিশ্লেষক

শনিবার, ৩০ জুন, ২০১২

নিজের সঙ্গেই যুদ্ধে লিপ্ত


 এম আবদুল হাফিজ
পশ্চাৎপদ দেশগুলোতে অথর্ব সরকারগুলোর রাষ্ট্রীয় সন্ত্রাসই উসকে দেয় এমন যুদ্ধকে। তারা এমনও ভাবে যে, প্রতিপক্ষকে এক হাত দেখিয়ে দিতে পেরেছে সরকার। কিন্তু সত্বরই তাদের এই আত্মপ্রসাদ উবে যায় যখন তারা দেখে যে ওই সন্ত্রাসের আগুন গণরোষানলের সঙ্গে একাকার হয়ে তাদের নিভৃত নিরাপদ বাসকেও গ্রাস করতে চলেছে। বিএনপির অপশাসন, অপকৌশল এবং স্ব-আরোপিত শাস্তি নিয়ে এন্তার লেখা হয়েছে, যদিও সেসব থেকে দলটি বিন্দুমাত্র শিক্ষা নেয়নি। একই পথে হাঁটছে আরেক দাম্ভিক নেতৃত্বের অধীন ঐতিহ্যবাহী আওয়ামী লীগ, যার গণবিরোধী সব নীতি ও পদক্ষেপকে মনে হবে যেন দলটি দেশ ও দেশবাসীর বিরুদ্ধেই যুদ্ধ ঘোষণা করেছে, যা প্রকারান্তরে জাতির নিজের সঙ্গে নিজেরই যুদ্ধের শামিল। আওয়ামী লীগ প্রতিশ্রুতির মধ্য দিয়ে বিশাল ম্যান্ডেট নিয়ে ২০০৮ সালের প্রদোষলগ্নে ক্ষমতার দুর্গে প্রবেশ করেছিল। অতঃপর প্রধানমন্ত্রীসহ আওয়ামী সরকারের সিংহভাগ মন্ত্রী-আমলার অনেক স্বপ্ন-সাধ পূর্ণ হয়েছে। রাষ্ট্রীয় আনুকূল্যে অনেকেই কোটিপতি হয়েছেন, যদিও নিন্দুকরা বলে যে কোটি টাকা তো মন্ত্রীর একজন পিএস/এপিএসও রোজগার করে বা ফেনসিডিল-ইয়াবা ফেরি করেও রোজগার হয়। মন্ত্রী-আমলাদের রোজগারের ওই ছকে ফেলা যায় না, সেটি তাদের জন্য মর্যাদাহানিকর।
কথা তো ছিল একটি দারিদ্র্যমুক্ত-বৈষম্যহীন সমাজ নির্মাণের। প্রধানমন্ত্রীসহ দেশের একাধিক বিশিষ্ট ব্যক্তিও সভা-সেমিনার-টক শোতে বিভিন্ন খাতে অগ্রগতির কথা বলেন। আরও বলেন, আর্থ-সামাজিক অনেক সূচকের ঊর্ধ্বগামিতার কথা। আমারও ওইসব শুনতে ভালো লাগে। কিন্তু সমস্যা যে বাস্তবে তার কোনোটাই খুঁজে পাই না।
পবিত্র রমজান মাসের প্রাক্কালে দ্রব্যমূল্য নিয়ন্ত্রণে রাখতে সরকারি পদক্ষেপগুলোর দীর্ঘ খতিয়ান সংবাদপত্রে আসতে শুরু করেছে। বিগত বছরগুলোতেও তা আসত, কিন্তু কখনোই আমরা বাজারে তার প্রভাব ঘটতে দেখিনি। অভিযোগ-পাল্টা অভিযোগের ভেতর দিয়ে একই রকম মহার্ঘতার বোঝা ঘাড়ে চাপিয়েই আমাদের পবিত্র মাসটি অতিক্রান্ত হতো। এই চিত্র সমাজের ও দেশের সব ক্ষেত্রেই। কৃচ্ছ্র সাধনের নামে পবিত্র ঈদেও সন্তান-সন্ততির সঙ্গে প্রতারণা ও বঞ্চনার খেলা খেলতে হয়েছে সীমাবদ্ধ আয়ের মানুষকে।
বিভিন্ন শ্রেণীতে বিভাজিত এ দেশে কর্তৃপক্ষ প্রকারান্তরে জনগণকে বুঝিয়েই দেয় যে_ ঈদ, ইফতার পার্টিসহ রমজান এবং এহেন অনুষ্ঠান উদযাপন মূলত এলিট শ্রেণীর, যাদের ট্যাঁকে আছে ছিনতাই-মুক্তিপণের, উৎকোচ-টেন্ডার বাণিজ্যের বা হাজারো কিসিমের অসদুপায়ে অর্জিত অগুনতি টাকা। এমন বিভাজন ও বিভক্তির একটি জাতি বড়জোর নিজেদের মধ্যেই উচ্ছিষ্ট নিয়ে কলহ করতে পারে, কিন্তু বহিঃশত্রুর বিরুদ্ধে কোনো দুর্ভেদ্য প্রাকার গড়ে তুলতে পারে না। তার জন্য চাই ইস্পাত ঐক্যের একটি জাতি, যার জীবন-দর্শন অভিন্ন এবং কট্টর সমাজতান্ত্রিক সাম্য না থাকলেও যাদের মধ্যে থাকবে আর্থ-সামাজিক সমতা। সেই অবস্থায় আর নেই এই জাতি। গণতন্ত্র, জাতীয়তাবাদ, অসাম্প্রদায়িকতাসহ সমাজতন্ত্রের প্রতিশ্রুতি দিয়ে এদেশ অস্তিত্বে এলেও, ছেঁড়া ন্যাকড়ার মতো ছুড়ে ফেলা হয়েছে সমাজতন্ত্রের মহান আদর্শকে এবং তার সঙ্গে উদ্ভব ঘটেছে নব্য ধনিক, নব্য রক্ষণশীলদের। তারা রাষ্ট্রের শেষ সম্বলটুকুও হস্তগত করতে ক্ষমতাসীন বনাম ক্ষমতাসীন দ্বন্দ্বে জড়িয়ে পড়ে। অভিবাসীদের কষ্টার্জিত অর্থ এবং আমাদের সুদক্ষ পোশাক শিল্পীদের শোষণ করে বা তাদের ন্যায্য পাওনা থেকে বঞ্চিত করে এ নব্য ধনিকরা নির্লজ্জ ভোগবাদ ও কনজ্যুমারিজমে লিপ্ত হয়। এই অস্থিতিশীল বিশৃঙ্খল দেশে তারা নিজেরাই তাদের উপার্জিত অর্থ বিনিয়োগ করতে চায় না। এও এক প্রকার যুদ্ধ, যা দেশের স্বার্থের বিরুদ্ধে পরিচালিত হয়।
জাতি নিজের সঙ্গে নিজেই যুদ্ধে লিপ্ত। কিন্তু জাতি তা উপলব্ধি করতে অক্ষম। জনগণ একটি ঘোরের মধ্যে বাস করছে। স্রেফ টিকে থাকার লড়াইয়ে মানুষ নিরন্তর ছুটছে। তার মহৎ কল্যাণকর বা অধিবিদ্যামূলক কিছু ভাবার অবকাশ নেই, যদিও এই প্রচণ্ড গতির যুদ্ধে সে নিজেই বারবার পরাজিত হচ্ছে। দেশ, সমাজ, রাজনীতি নিয়মের নিগড় ভেঙে যে চলার পথ বেছে নিয়েছে, নিয়মের অভাবেই তা তার সাবলীলতাকে ধ্বংস করে তার সৃজনশক্তিকে বাধাগ্রস্ত করবে।
এখনও এ দেশের ভাণ্ডারে যা আছে বা যা উৎপাদিত হতে পারে, যদি নব্য ধনতন্ত্রের নিয়ন্ত্রণহীন বিকাশের লাগামকে টেনে ধরতে পারি, রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক শৃঙ্খলাকে ফিরিয়ে আনতে পারি এবং দেশটাকে প্রাণভরে ভালোবাসতে পারি তাহলে সম্ভাবনার সীমা নভোমণ্ডলকেও ছাড়িয়ে যেতে পারে। ঞযবহ ংশু রিষষ নব ড়ঁৎ ড়হষু ষরসরঃ.


ব্রিগেডিয়ার (অব.) এম আবদুল হাফিজ : সাবেক মহাপরিচালক বিআইআইএসএস ও কলাম লেখক

শনিবার, ২৩ জুন, ২০১২

পারস্পরিক অপরিহার্যতাই পাক মার্কিন মৈত্রীর নেপথ্য শক্তি




এম আবদুল হাফিজ
২০১১ সালের ২২ সেপ্টেম্বর মার্কিন জয়েন্ট চিফস অব স্টাফের তৎকালীন চেয়ারম্যান অ্যাডমিরাল মাইক মুলেন ওই পদে থাকা অব¯’ায় শেষবারের মতো সিনেট আর্মড ফোর্সেস কমিটির মুখোমুখি হন। সেখানে তার বক্তব্যে তিনি অশিষ্টভাবে পাকিস্তানের সমালোচনা করেন। তিনি কমিটিকে স্পষ্টই বলেন, উগ্রবাদী ধর্মীয় সংগঠনগুলো কার্যত সেখানকার সরকারের হয়েই আফগান সৈন্য এবং বেসামরিক লোকজনসহ মার্কিন সৈন্যদের ওপরও হামলা চালিয়ে যা”েছ। হাক্কানি নেটওয়ার্ক সম্বন্ধে তিনি বলেন, ওটি আসলে গোয়েন্দা সং¯’া আইএসআইরই একটি কৌশলগত শাখা। মুলেন প্রদত্ত তথ্য অনুযায়ী এ নেটওয়ার্ক ২০১১ সালের জুন মাসে কাবুলের ইন্টারকন্টিনেন্টাল হোটেলে আক্রমণ চালায়। অতঃপর বছরের সেপ্টেম্বরে ওয়ার্দাক প্রদেশে ট্রাক-বোমার হামলা এবং সে মাসেই কাবুলে মার্কিন দূতাবাসে সন্ত্রাসী হামলা চালায়। 
এত কিছু বলার পরও মুলেন প্রত্যাশিত উপসংহারে আসেননি। পাকিস্তানের বির“দ্ধে এমন একগাদা অভিযোগ থাকা সত্ত্বেও মুলেন একথা বলা থেকে বিরত থাকেন যে, ‘পাকিস্তানকে একটি বৈরী শক্তি হিসেবে শনাক্ত করা হোক’। বরং মুলেনের সাক্ষ্য-প্রমাণের ক’দিন পর আবার আগের মতো পাকিস্তান ও যুক্তরাষ্ট্র উভয়েই তাদের সন্ত্রাসবিরোধী যুদ্ধে তথাকথিত সহযোগিতা বা তার ভান করতে স্ব স্ব ভূমিকায় ফিরে যায়। অর্থাৎ কেউ কাউকে বিশ্বাস না করেও আগের মতো পরস্পরের ‘সহযোগিতা’ করতে থাকে। এর কারণ যুক্তরাষ্ট্র জানে, পাকিস্তান ছাড়া তাদের গত্যন্তর নেই। যেমন পাকিস্তানও জানে যে, যতই অপ্রিয় হোক মার্কিন সাহায্য ছাড়া তারা অচল। 
যুগ যুগ ধরে মার্কিনিরা পাকিস্তানি সাহায্যকে খরিদ করেছে। শুধু এক-এগারোর পরই পাকিস্তানকে প্রদত্ত মার্কিন সাহায্যের পরিমাণ ২০ বিলিয়ন ডলার। এটাই শুধু পাকিস্তানি সহযোগিতার মূল্য নয়, সেই সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্র পাকিস্তানকে অজস্র প্রশংসায় ধন্য করেছে। ২০০৭ সালে মুলেন জয়েন্ট চিফস অব স্টাফে নিয়োগ পাওয়ার পর ইসলামাবাদে তার প্রথম সংবাদ সম্মেলনে পাকিস্তানকে ‘অটল ঐতিহাসিক মিত্র’ বলে অভিহিত করেছিলেন। ২০০৮ সালে মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী কন্ডোলিৎসা রাইস পাকিস্তান সম্বন্ধে বলেছিলেন, ‘এটি এমন একটি দেশ যা সন্ত্রাসের সঙ্গে যুক্ত হওয়া তো দূরের কথা, বরং যেখানেই সন্ত্রাসের গন্ধ পাওয়া যায়, সেখানেই এই দানবের বির“দ্ধে লড়ে আসছে। 
ইত্যবসরে মার্কিন নেতৃত্ব পাকিস্তানি নেতৃত্বের সঙ্গে মিথষ্ক্রিয়ায় অনানুপাতিক সময়ও ব্যয় করেছে। পররাষ্ট্রমন্ত্রী হিসেবে হিলারি ক্লিনটন ভারতে দু’বারের বিপরীতে চারবার পাকিস্তান সফর করেছেন। অ্যাডমিরাল মুলেন বিশ বিশবার পাকিস্তানে এসেছেন। এতদসত্ত্বেও পাকিস্তানের বির“দ্ধে কুৎসায় মুলেনই প্রথম ব্যক্তি নন এবং তিনি ওই ভূমিকায় সর্বশেষও হবেন না। ২০০৮ সালে সিআইএ কাবুলে ভারতীয় দূতাবাসে বোমা হামলার জন্য পাকিস্তানকে দেষী করেছিল। ২০১১ সালে এবোটাবাদে ওসামা বিন লাদেনের আস্তানায় নেভি সিলস কমান্ডোদের হামলার মাত্র দু’মাস পর অ্যাডমিরাল জেম্স্ উইন ফিল্ড জয়েন্ট চিফসের ভাইস চেয়ারম্যান হিসেবে সিনেটের আর্মড ফোর্সেস কমিটিতে সাক্ষ্য দানকালে পাকিস্তানকে অত্যন্ত জটিল পার্টনার বা সহযোগী বলেছিলেন। ওই বছরেই হিলারি ক্লিনটন এক সংবাদ সম্মেলনে আফগান প্রেসিডেন্ট হামিদ কারজাইয়ের উপ¯ি’তিতে বলেছিলেন, ওবামা প্রশাসন পাকিস্তানিদের জোর-ধাক্কা দিয়ে সহযোগিতায় সক্রিয় করতে চেয়েছিল। তাই তা ফল বয়ে আনুক বা না আনুক, ওয়াশিংটনের পাকিস্তানকে সমালোচনা এবং সঙ্গে কিছু সাহায্যের থলি আসলে সন্ত্রাসবিরোধী যুদ্ধের কৌশলের অংশ, কিš‘ সে কৌশল সামান্যই সফল হয়েছে। ভয়ভীতি প্রদর্শন বা সমালোচনায় পাকিস্তানে কোন কাজ হয় না, কারণ ইসলামাবাদের নেতারা ভয়ভীতির ঊর্ধ্বে। কেননা যুক্তরাষ্ট্রই যে পাকিস্তানকে ভয় করে, এর কিছু ঘটনা অজ্ঞাত থাকেনি। মার্কিনিদের বিশ্বাস, পাকিস্তানি নীতি সাহায্যকারী না হলেও তা আরও খারাপ হতে পারত। ওয়াশিংটন এক রকম ধরেই নিয়েছে, যুক্তরাষ্ট্র পাকিস্তানকে সঙ্গে না রাখলে এবং ইসলামাবাদ আফগানিস্তানে সব সহযোগিতা বন্ধ করে দিলে সেটা হবে মার্কিনিদের সন্ত্রাস প্রতিরোধ যুদ্ধের সমাপ্তি। 
আরও সমস্যা যেÑ যেমনটা চলমান ভাবনায় প্রকাশ পায়Ñ বাইরের কোন সাহায্য-সমর্থন ব্যতিরেকে রাষ্ট্র হিসেবে নড়বড়ে পাকিস্তানের ভেঙে পড়ার আশংকা। এমন অব¯’ার উদ্ভব হলে ইসলামাবাদে একটি উগ্রবাদী শাসনের আশংকা উড়িয়ে দেয়া যায় না। তা যদি হয়, স্বভাবতই সেক্ষেত্রে পাকিস্তান-যুক্তরাষ্ট্র মৈত্রী তো দূরের কথা, উভয়ের মধ্যে ক্ষীণতম সংযোগের সুযোগও হয়তো থাকবে না। আফগানিস্তানে মার্কিন সমর্থনপুষ্ট কারজাই সরকারের সঙ্গেও হয়তো পাকিস্তানের সম্পর্ক ছিন্ন হয়ে যাবে। ফলে সমগ্র অঞ্চলে অ¯ি’রতা ছড়িয়ে পড়বে। এমন অব¯’া এই অঞ্চলে যুক্তরাষ্ট্রের কায়েমি স্বার্থকে ক্ষুণœ করবে। শুধু তাই নয়, ইসলামাবাদকে উগ্রবাদীদের হাতে পড়তে দিলে এমনকি একটি পারমাণবিক যুদ্ধ অন্তত ভারত-পাকিস্তানের মধ্যে সংঘটিত হতে পারে। 
পাকিস্তান-মার্কিন মৈত্রী সমস্যা সংকুল হলেও এর অর্জনও কিš‘ একেবারে নগণ্য নয়। এতদিন ধরে পাকিস্তানই তো মার্কিন সৈন্যদের জন্য রসদ সামগ্রী পাকিস্তানি ভূখণ্ডের মধ্য দিয়ে সরবরাহের সুযোগ দিয়েছে। এখন ন্যাটো না হয় মধ্য এশিয়া ও র“শ বদন্যতায় বিকল্প সরবরাহের পথ খুঁজে পেয়েছে। কিš‘ নয়-এগারোর প্রথম প্রহরে পাকিস্তানই ঝুঁকি নিয়ে সন্ত্রাসবিরোধী যুদ্ধের অনুকূলে সরবরাহ পথ দেয়া ছাড়াও অনেক মূল্যবান ভূমিকা রেখেছে। অনেক শীর্ষ আল কায়দা নেতাকে পাকড়াও করে পাকিস্তান কর্তৃপক্ষ মার্কিনিদের হাতে তুলে দিয়েছে। নয়-এগারোর একজন পরিকল্পক খালিদ শেখ মুহম্মদকে পাকড়াও করতে পাকিস্তানের অবদান আছে। এছাড়া আফগানিস্তানে ড্রোন হামলার সূত্রপাতই হয়েছিল বেলুচিস্তানে পাকিস্তান প্রদত্ত ঘাঁটি থেকে। 
তবু পাকিস্তানে মার্কিন সাহায্যের সব অবদানই ম্লান হয়ে যায়, যখন অনেক বিষয়েই পাকিস্তানের জেদি অসহযোগিতা বিবেচনায় আনা হয়। ইতিমধ্যেই পাকিস্তানের দুর্নাম হয়েছে বিশ্বে সর্বাপেক্ষা মারাÍক পরমাণু বিস্তারের হোতা হিসেবে। পাকিস্তান কর্তৃপক্ষ তথাকথিত এ কিউ খান নেটওয়ার্কের মাধ্যমে ইরান, লিবিয়া ও উত্তর কোরিয়ায় অর্থের বিনিময়ে পারমাণবিক প্রযুক্তি পাচার করেছে বলে অভিযোগ আছে। 
পাকিস্তান আল কায়দা, তালেবান ইত্যাদি জঙ্গিগোষ্ঠীর বির“দ্ধাচারণ করলেও হাক্কানি নেটওয়ার্কসহ আফগান-তালেবান এবং হিজবে ইসলামীর মতো জঙ্গি গোষ্ঠীগুলোকে প্রকাশ্যে না হলেও সমর্থন করে। কারণ তাদের দিয়ে ভারতকে এবং কোয়ালিশন সেনাদেরও সন্ত্রাসী চাপে রাখা যায়। অনেক পাকিস্তানি কর্মকর্তা আবার ড্রোন হামলাকে উৎসাহিতও করে। তবে একাধিক কারণে বিন লাদেন হত্যা এবং পাকিস্তানি সার্বভৌমত্ব লংঘন করে মার্কিন কমান্ডোদের হেলিকপ্টারে পাকিস্তানে প্রবেশের ঘটনায় পাকিস্তানিরা ক্ষুব্ধ প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করেছে, যার জের এখনও চলছে। সিআইএ’র চর রেমন্ড লাহোরে দুই পাকিস্তানিকে হত্যা করা সত্ত্বেও তাকে যুক্তরাষ্ট্রে প্রেরণকে ঘিরে পাকিস্তানিদের মধ্যে অনেক অসন্তোষ আছে। সর্বোপরি পাকিস্তানেরই অংশ উপজাতীয় অঞ্চলে নির্বিচার মার্কিন ড্রোন হামলা এবং তাতে বেসামরিক নাগরিকদের মৃত্যু পাকিস্তানে এক প্রচণ্ড মার্কিনবিরোধী অনুভূতি সৃষ্টি করেছে, যা অব্যাহত আছে। 
তা সত্ত্বেও সব দিক বিচার করে পাক-মার্কিন মৈত্রী টিকে থাকবে। সেই পঞ্চাশের দশক থেকে পাকিস্তান যখন প্রথম আঙ্কল স্যামের আলিঙ্গনে ধরা দিয়েছিল, সেই থেকেই পাক-মার্কিন সম্পর্কে অনেক চড়াই-উৎরাই এসেছে এবং সেসব মোকাবেলা করেই আজও দু’দেশের মৈত্রী অনেক বিতর্কিত হয়েও টিকে আছে। এবং এই দীর্ঘদিনে উভয় দেশই পরস্পরের প্রতি এতটাই আসক্ত যে, যতই নড়বড়ে হোক একটি মৈত্রী বন্ধন পরস্পরের স্বার্থেই টিকে থাকবে। সন্ত্রাস মোকাবেলার জন্য যুক্তরাষ্ট্রের পাকিস্তানি ভূখণ্ড ও সামরিক বাহিনী যেমন প্রয়োজন, তেমনি লুটেপুটে খাওয়া এক কংকালসার পাকিস্তানের অস্তিত্বের জন্য একইভাবে দরকার মার্কিন সাহায্য ।
এম আবদুল হাফিজ : নিরাপত্তা বিশ্লেষক ও কলাম লেখক

প্রবাদের উটের পৃষ্ঠে সর্বশেষ খড়কুটো


 এম আবদুল হাফিজ
প্রবাদের উটের পৃষ্ঠে সর্বশেষ খড়কুটো চাপানোর বোঝা আমরা এ দেশের সাধারণ মানুষ আমাদের পৃষ্ঠেই ধারণ করে ছেচড়িয়ে ছেচড়িয়ে সামনে এগোচ্ছি যে কোনো মুহূর্তে থুবড়ে পড়ার শঙ্কা নিয়ে। দৈনন্দিন খরচ মেটাতে গত এক বছরে মানুষের ব্যয় বেড়েছে ৫০ শতাংশের অধিক, যার বিপরীতে আয় বৃদ্ধি পেয়েছে মাত্র ১৮ শতাংশ। নিরুপায় মধ্য ও নিম্নবিত্তরা ব্যয় সংকোচন করে এবং প্রয়োজনের অনেক কিছু বর্জন করেও আয় ও ব্যয়ের মধ্যে সমন্বয় সাধন করতে পারছেন না। হিড়িক পড়েছে পেনশনভোগী ও নিম্নবিত্তদের মধ্যে সঞ্চয়পত্র ভাঙানোর। ব্যয় সংকোচন করতে তারা মারাত্মক ব্যাধি না হলে চিকিৎসায়ও বিমুখ। কিন্তু অর্থনীতিবিদদের প্রদত্ত পূর্বাভাসে বোঝা যায় যে, এত কিছু করে আগামীর জীবনেও কোনো সুদিনের সুখবর নেই। বরং ক্রমবর্ধমানভাবেই এই মহার্ঘতা দানবীয় রূপ ধারণ করছে। তা নিত্যপণ্যের মূল্যেই হোক, বাড়ি ভাড়ায়ই হোক, যানবাহনের ভাড়ায়ই হোক, লেখাপড়ার বা চিকিৎসার খরচেই হোক_ সর্বত্র একই অবস্থা, একই ভীতি, একই নৈরাশ্য। এমনই এক প্রেক্ষিতের বিপরীতে আমাদের রস-রসিকতায় টইটম্বুর এককালের স্বৈরশাসক এরশাদেরও অর্থমন্ত্রী সম্ভবত ক্ষমতাসীন মহাজোট সরকারের এই মেয়াদের শেষ বাজেটটি পেশ করেছেন। অকপটে স্বীকার করে নিচ্ছি যে, বাজেট-পাটিগণিতের মারপ্যাঁচ কদাচিৎ আমার বোধগম্য। ওইগুলো বোঝার জন্য আছে সিপিডি, বিআইডিএস, কেন্দ্রীয় ব্যাংক ও বিশ্ববিদ্যালয়ে অর্থনীতি বিভাগের অর্থনীতিবিদরা। তাদের এক্সপার্ট মতামত এবং কোথাও নেই কিন্তু দেশের অর্থনৈতিক অঙ্গনে লব্ধপ্রতিষ্ঠ এমন বিশেষজ্ঞদের মত ও মন্তব্য এখনও অব্যাহত আছে। তাদের প্রায়ই সাংঘর্ষিক মতামতে আরও বিভ্রান্ত হতে হয়। আমার মতো ছাপোষা সাধারণ মানুষ আগ্রহ ভরে দেখে যে, অন্তত আগামী এক বছর জীবনটা কীভাবে এবং কেমন কাটবে।
প্রস্তাবিত বাজেটের আলোকে সেখানেও আমাদের মতো অর্থনীতিবিদ মির্জ্জা আজিজুল ইসলাম থেকে সিপিডির ফেলো দেবপ্রিয়র মতানুযায়ী সামনে মুদ্রাস্ফীতি কমার কোনো সম্ভাবনা নেই। তার মতে, আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের চাপে জ্বালানির দাম বাড়ানো হলে মুদ্রাস্ফীতিতে খুবই প্রভাব পড়বে। অথচ আন্তর্জাতিক বাজারে জ্বালানির মূল্য কমেছে। তা সত্ত্বেও জ্বালানির মূল্যবৃদ্ধি, যাতে নিত্যপণ্যসহ পরিবহন ইত্যাদি সবকিছুর খরচ ঊর্ধ্বমুখী হবে_ যৌক্তিক নয়। তা ছাড়া বছর বছর বিদ্যুতের দাম বৃদ্ধি করে রেকর্ড গড়েছে মহাজোট সরকার। ক্ষমতা গ্রহণের পর মহাজোট সরকার পাইকারি বিদ্যুতের দাম পাঁচবার ও খুচরা বিদ্যুতের দাম চারবার বৃদ্ধি করেছে। এরপরও কখন, কোন সেবা খাতের মূল্য কতটা বাড়বে তারও গুঞ্জন রয়েছে। কার্যত সর্বক্ষণ আমাদের গর্দানের ওপর অস্বস্তিকরভাবে ঝুলে আছে ডেমাক্লিসের তলোয়ার।
মাননীয় প্রধানমন্ত্রী, আমাদের মতো চালচুলোহীন মানুষকে সুখস্বপ্ন দেখান যে, আমরা ২০২০ সালের মধ্যে মধ্যম আয়ের দেশে পরিণত হলেই আমাদের আয় ও ব্যয়ের বৈষম্য দূর হবে। হয়তোবা হবে। কিন্তু তাই বলে তো সামাজিক বৈষম্য ফুৎকারে উবে যাবে না। সেটি তো একটি কাঠামোগত বা শ্রেণী বিভাগভিত্তিক বাস্তবতা। তাই সম্ভবত তেমন আয়ের দেশেও বিভক্তি একটি থেকেই যাবে। তাই আমজনতার জন্য অন্ধকার হয়তো ঘুচবে না, তাদের দুর্দিনের অবসানও ঘটবে না। অন্তত এবারে বাজেটে তার কোনো সংকেত নেই। মধ্যম আয়ের দেশে পরিণত হওয়ার একটি গুরুত্বপূর্ণ সোপান প্রবৃদ্ধি। জিডিপি প্রবৃদ্ধির যে লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছে তা অর্জনের ব্যাপারে সংশ্লিষ্ট প্রায় সবাই সন্দিহান। করারোপের পরিধি সম্প্রসারণে যাদের করের আওতায় আনা হয়েছে তার অন্তর্ভুক্ত কেউই কর প্রদানে সক্ষম নন।
বাজেট আসে বাজেট যায়_ আমাদের ভাগ্যের কোনো ইতিবাচক পরিণতি নেই। যেই যেখানে ছিলাম, সেখানেই আছি। অথবা আগের অবস্থান থেকেও পেছনে ছিটকে পড়েছি। জঠরের দাবি, পরিবারের যৎসামান্য শখ-আহ্লাদ বা নিজের মান-সম্ভ্রম_ এগুলোর মধ্যে একটি ভারসাম্য বহাল রাখতেই সার্বক্ষণিক যুদ্ধ। টানাপড়েনের জীবনে অনেক অজানা বিষয় থাকে, যা কারও সঙ্গে শেয়ার করা যায় না। শুধু এক বোবা অনুভূতির শিরা বেয়ে নিরন্তর রক্তক্ষরণ হতে থাকে।
মধ্য আয়ের বা নিম্ন আয়ের দেশের সিংহভাগ মানুষের আয়ে কোনো প্রবৃদ্ধি নেই। তারা বাজেটে বর্ণিত ছয়, সাত বা দশ শতাংশ প্রবৃদ্ধিতেও নিশ্চল, প্রতিক্রিয়াহীন। কেননা তাতে তাদের কী এসে যায়। কার্যত এসবই বিত্তবানদের বিষয়, যাদের আয়-ব্যয়ে বাজেট প্রভাব বিস্তার করে। হায় রে 'মধ্যম আয়ের দেশ', আমাদের কল্পনায় তা ধরাও যায় না, ছোঁয়াও যায় না। ছোঁয়ার কখনও কোনো স্পৃহাও হয় না!

ব্রিগেডিয়ার (অব.) এম আবদুল হাফিজ :সাবেক মহাপরিচালক বিআইআইএসএস ও কলাম লেখক

মঙ্গলবার, ১৯ জুন, ২০১২

মিসরে রাজনীতি এবং সামরিক বাহিনী

মিসরে রাজনীতি এবং সামরিক বাহিনী



॥ এম. আবদুল হাফিজ ॥

দেশে স্থিতিশীলতা আনয়নের একটি ঘোষিত লক্ষ্যে প্রেসিডেন্ট হোসনি মোবারকের পদত্যাগের পর গণতন্ত্রের পথ সুগম করতে এবং একটি বেসামরিক সরকারের কাক্সিত অধিষ্ঠানের লক্ষ্যে মিসরের হাইয়ার মিলিটারি কাউন্সিল ২০১১ সালের ১১ ফেব্রুয়ারি ক্ষমতা গ্রহণ করে। মিসরে বিক্ষোভকান্ত জনগণ সম্ভাব্য নৈরাজ্য এড়াতে তাদের ভূমিকাকে স্বাগত জানায়। তা ছাড়া আর্মি এমন কোনো আভাসও প্রদর্শন করেনি যে, তারা রাজনৈতিক দৃশ্যপট নিয়ন্ত্রণে আগ্রহী। এর চেয়ে কোনো ভালো বিকল্প না থাকায় মিলিটারি অনিচ্ছা সত্ত্বেও অন্তর্বর্তীকালের জন্য সর্বসম্মতিক্রমে শৃঙ্খলা ও স্থিতিশীলতা পুনর্বহালের দায়িত্ব নেয়। অনেক সময় অনেক স্থানেই অচলাবস্থা বা দেশ কোনো বিপদের মুখোমুখি হলে মিলিটারি সেই জট ভাঙতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকায় নেমেছে। এখন কি সেই একই মিলিটারি কোনো বেসামরিক ব্যক্তিত্বের প্রেসিডেন্সি পদাধিকারের বিরোধী? এর সর্বোত্তম উত্তর : অনেক কিছুর ওপর তা নির্ভরশীল।
মিসরের নেতৃস্থানীয়রা অনেক কিছুতেই মতভেদ পোষণ করে থাকেন। কিন্তু যে একটি বিষয়ে তাদের মতৈক্য রয়েছে তা হলোÑ মিসরকে আরব বিশ্বে অবশ্যই একটি কেন্দ্রীয় ভূমিকায় থাকতে হবে। ১৯৫২ সালে কর্নেল গামাল আবদেল নাসেরের সামরিক অভ্যুত্থান এবং তার বিপ্লবী কমান্ড কাউন্সিলের একটি র‌্যাডিক্যাল জাতীয়তাবাদী পূর্বাভিমুখীনতা (Orientation) কোটি কোটি আরবকে আকর্ষণ করেছিল এবং সিরিয়া, ইরাক, লিবিয়া, সুদান ও ইয়েমেনে পরবর্তীকালে অভ্যুত্থানের মডেল হিসেবে কাজ করেছিল।
সেই সময় থেকেই মিসরের অভ্যন্তরীণ বা বৈদেশিক নীতিতে আমূল পরিবর্তন হলেও যা নাসেরের সময় থেকেই অপরিবর্তিত থেকে যায়, তা হলোÑ দেশটি সব সময়েই একজন সামরিক প্রেক্ষাপটের প্রেসিডেন্ট দ্বারা শাসিত হয়েছে। শুধু তাই নয়, সেই প্রেসিডেন্ট আবার সশস্ত্র বাহিনীর ওপর নির্ভর করেছেন তার সমর্থনের, গ্রহণযোগ্যতার ও বৈধতার জন্য। জাতীয় জীবনের সন্ধিক্ষণসমূহে মিলিটারির কর্তৃত্ববাদী নিয়ন্ত্রণ সরকারের টিকে থাকার জন্য গুরুত্বপূর্ণ প্রমাণিত হয়েছে।
১৯৫২ সালে মিসরে মিলিটারি ক্ষমতা গ্রহণের পর রাজনৈতিক দলগুলোকে নিষিদ্ধ করা হয়। সব গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত গ্রহণ করতে থাকে বিপ্লবী কমান্ড কাউন্সিল। সামরিক কর্মকর্তারাই প্রধান সরকারি পদগুলো অলঙ্কৃত করেন। তারাই হয়ে পড়েন দেশের কৌশলগত সংখ্যালঘিষ্ঠ গোষ্ঠী, যার অন্তর্ভুক্ত হন প্রেসিডেন্ট, ভাইস প্রেসিডেন্ট, প্রধানমন্ত্রী ও অন্যান্য গুরুত্বপূর্ণ মন্ত্রী। তাদের মধ্য থেকেই নিযুক্ত হন সেনাপ্রধান, জাতীয় নিরাপত্তা প্রধান, ক্ষমতাসীন দলের প্রধান, এমনকি বিচার বিভাগের চেয়ারম্যান। এক কথায়, এতে উদ্ভব ঘটে একপ্রকারের প্রেসিডেন্টসিয়াল রাজতন্ত্র। এটি মিলিটারি বোনাপার্টিজমের মিসরীয় সংস্করণ। মজার কথা, সামরিক নেতৃত্ব কোনো জবাবদিহিতায় বিশ্বাস করে না বা গ্রহণ করে না। তাদের ওপর নেই কোনো বেসামরিক নিয়ন্ত্রণ।
১৯৬৭ সালে ছ’দিনের আরব-ইসরাইল যুদ্ধে মিসরের শোচনীয় পরাজয় ছিল মিলিটারির রাজনৈতিক ভূমিকায় একটি টার্নিং পয়েন্ট। খোদ মিলিটারির জবাবদিহিতা নিয়ে উচ্চকণ্ঠ স্লোগান উত্থিত হয়েছিল। তখন মিসরের যে জনগণকে ওই অঞ্চলের সবচেয়ে শক্তিশালী সেনাবাহিনীর প্রতিশ্রুতি দেয়া হয়েছিল, তারা দ্রুত উপলব্ধি করল যে, তারা নেতৃত্বের অমার্জনীয় অবহেলায় পথভ্রষ্ট হয়েছে। এরপর থেকেই শ্রমিক-ছাত্র বিক্ষোভের মাধ্যমে মিসরীয়রা নিরাপত্তা বাহিনীর সংস্কারের দাবি তুলেছিল। যুদ্ধে পরাভূত সামরিক কর্মকর্তারাই বিক্ষোভকারীদের লঘু হলেও শাস্তি দান করতে থাকলে উত্তেজিত বিক্ষোভকারীরা মিলিটারির একটি বিশেষ সুবিধাভোগী শ্রেণীর নিরঙ্কুশ ক্ষমতা এবং গোয়েন্দা সংস্থার নিয়ন্ত্রিত রাষ্ট্রের পরিসমাপ্তির দাবিতে সোচ্চার হয়েছিল। বিকল্প হিসেবে তারা তুলে ধরেছিল দীর্ঘস্থায়ী সংগ্রামের জন্য একটি বিপ্লবী সংগঠনের উদ্ভাবন।
কিন্তু মিসরে সামরিক পরাজয়ের বিপর্যয়ের পর মন্ত্রিসভায় সামরিক বাহিনীর সদস্যদের অনুপাত শতকরা ৬৬ ভাগ থেকে ২২ ভাগে নেমে যায়। ১৯৭৫ সাল নাগাদ তা আরো হ্রাস পেয়ে ১৫ ভাগে নেমে আসে। সত্তরের দশকে মিসরীয় অভ্যন্তরীণ ও বৈদেশিক নীতিতে অনেক পরিবর্তন হওয়ায় সামরিকই স্টাব্লিশমেন্ট রাজনৈতিক নেতৃত্বের সিদ্ধান্তই শিরোধার্য করে। ১৯৮৬ সালে সামরিক বাহিনী আধাসামরিক নিরাপত্তা বাহিনীর বিদ্রোহ দমনেও হস্তক্ষেপ করেছিল। আশির দশকের শেষ ভাগে ও নব্বইয়ের দশকের শুরুতে মিসরীয় সরকারের জন্য হুমকির উৎস সামরিক বাহিনী ছিল না, বরং তার স্থান নিয়েছিল ইসলামি জঙ্গি গোষ্ঠী। এই জঙ্গিরা আর্মির নিম্ন ও মধ্যস্তরে অনুপ্রবেশের প্রাণান্তকর চেষ্টা করেছিল।
ইসলামি লিবারেশন পার্টি নামক এক জঙ্গি গোষ্ঠী প্রেসিডেন্ট আনোয়ার সাদাতকে উৎখাত করার চেষ্টা করেছিল। অন্য একটি জঙ্গি সংগঠন জিহাদ আল জুমার নামে গোয়েন্দা সংস্থার কর্নেলের নেতৃত্বে সাদাতকে হত্যা করতে সক্ষম হয়। এই পর্যায়ে যদি আর্মি ক্ষমতা গ্রহণ করে, তারা দেশকে খুব একটা কিছু দিতে পারবে না বলে তারা জানে। তাদের কাছে মিসরের পুঞ্জীভূত ঋণ পরিশোধের কোনো উপায় জানা নেই। জানা নেই সামাজিক অস্থিরতা এবং গোষ্ঠীগত বিভেদ ও তজ্জনিত উত্তেজনার কোনো সমাধান। আর্মি জানে যে, দেশের বিশাল বেকারত্ব দূরীকরণে তাদের কাছে কোনো জাদু নেই। সর্বোপরি মিসরের দীর্ঘ দিনের মিত্র যুক্তরাষ্ট্রের সাথে সম্পর্ককে স্থিতিশীল রাখারও কোনো মন্ত্র নেই আর্মির কাছে।
২০১০ সালের শুরুতে হোসনি মোবারক জোর দিয়েই বলেছিলেন, তিনি বিশ্বাস করেন না যে আর্মি প্রেসিডেন্সির জন্য কোনো বেসামরিক প্রার্থীর বিরোধিতা করবে। কিন্তু যে বেসামরিক প্রার্থীর কথা তার মনে ছিল তিনি হলেন তারই পুত্র গামাল মুবারক, বিরোধীদলীয় নেতা এল বারাদি নন। তবে আর্মির বিরোধিতা না করা সংক্রান্ত তার ধারণা সত্যই ছিল। আর্মি বর্তমানের প্রেক্ষাপটে আর প্রেসিডেন্সিতে আগ্রহী নয়। কিন্তু কিছু বিষয়ে আর্মি এখনো আগ্রহী।
প্রথমত, আর্মির জন্য ভর্তুকি ব্যবস্থার প্রলম্বন, যা ক্রমবর্ধমান মুদ্রাস্ফীতি থেকে আর্মিকে সুরক্ষা দেবে। মার্কিন অর্থায়নে সৃষ্ট এক প্রচণ্ড অর্থলিপ্সা শুধু মোবারক বা তার অনুগত জেনারেলদেরকেই নয়, সমগ্র আর্মিকে সংক্রমিত করে রেখেছে। আর্মির কর্মকর্তা শ্রেণী মিসর-মার্কিন মৈত্রীর দিনগুলোতে দেখেছে যে, কায়রোর আমেরিকান বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন গ্র্যাজুয়েট সিটি ব্যাংক জাতীয় কোনো করপোরেশনে চাকরি করে একজন জেনারেলের চেয়ে চার গুণ অধিক রোজগার করতে পারেন।
তবে তাদের অন্তরে লালিত একপ্রকার ভোগবাদের পূর্বশর্ত হলোÑ দেশে স্থিতিশীলতা। যে মহলই সেই স্থিতিশীলতার বিধান করতে সক্ষম, রাষ্ট্রক্ষমতা তাদের হাতে চলে যাওয়ায় মিসরীয় সামরিক বাহিনীর কোনো ক্ষোভ বা দুঃখ নেই। 
লেখক : অবসরপ্রাপ্ত ব্রিগেডিয়ার এবং নিরাপত্তা, রাজনীতি, বৈদেশিক নীতি ও আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিশ্লেষক

শনিবার, ১৬ জুন, ২০১২

দোহাই, আমাদের আশা ও বিশ্বাসের ভিত ভাঙবেন না


এম আবদুল হাফিজ
ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ নেতৃত্বাধীন মহাজোটের জনপ্রিয়তা কমেছে, তবে ঠিক কতটা কমেছে তা শুধু আগামী সাধারণ নির্বাচনে বোঝা যাবে। সমস্যা যে, একথা কবুল করতেও ক্ষমতাসীনদের অনীহা। বিগত যৌবন নর-নারী যেমন নানাভাবে তাদের যৌবনকে অপরিবর্তিত দেখানোর চেষ্টা করে, তেমনি মহাজোট বিশেষ করে আওয়ামী লীগ তাদের জনপ্রিয়তা অক্ষত রাখার সার্টিফিকেট সংগ্রহে ব্যস্ত। কিছুদিন আগে কোথায় না কোথায় প্রকাশিত যুক্তরাষ্ট্রের গ্যালাপ জরিপে প্রধানমন্ত্রীর জনপ্রিয়তার শীর্ষ অব¯’ান নিয়ে শেখ হাসিনা গণভবনে তার নিয়মিত মিথষ্ক্রিয়ায় গর্বও করেছেন, যদিও আমরা এ দেশবাসী ভিন্ন চিত্র দেখছি। দেখছি আওয়ামীদের জনপ্রিয়তা তথা ক্ষমতা ধরে রাখার প্রাণান্ত প্রচেষ্টা। যদিও সে সম্ভাবনা ক্রমেই ক্ষীণ হয়ে আসছে।
আওয়ামীরা তাদের ছিয়ানব্বইয়ের মেয়াদ শেষেও অনেক কূটকৌশল এঁটেছিল। তৎকালীন রাষ্ট্রপতি বিচারপতি সাহাবুদ্দীন তাদের কিছু অনৈতিক আবদার মেনে না নেয়ায় তার সঙ্গে আওয়ামীদের মনোমালিন্যও হয়েছিল, যা শেষ পর্যন্ত তিক্ততায়ও পর্যবসিত হয়। এতদসত্ত্বেও ‘জনতার মঞ্চ’ ইত্যাদির মাধ্যমে অর্জিত তত্ত্বাবধায়ক সরকার তখন বহাল থাকা সত্ত্বেও আওয়ামী লীগ পরবর্তী নির্বাচনে (২০০১ সাল) পুনর্নির্বাচিত হওয়া সম্বন্ধে নিশ্চিত হতে পারেনি। তাই তারা বিচারপতি সাহাবুদ্দীনের শরণাপন্ন হয়েছিল প্রশাসনিক বেশ কিছু বিন্যাসের জন্য, যা নির্বাচনকে তাদের অনুকূলে প্রভাবান্বিত করবে।
অবশ্য এমন অপকর্ম বিএনপিও করেছিল যা বিরোধীদের তত্ত্বাবধায়ক আন্দোলনকে উসকে দিয়েছিল। একতরফাভাবে দলটি বিচারপতি সাদেককে প্রধান নির্বাচন কমিশনার নিয়োগ দিয়েছিল। উদ্দেশ্য একই, নির্বাচনকে প্রভাবান্বিত করা। প্রবল আন্দোলনের মুখে একটি প্রহসনের নির্বাচন হলেও এবং বিএনপি তাতে জিতলেও ওই ‘নির্বাচিত’ সরকার তড়িঘড়ি সংসদে ত্রয়োদশ সংশোধনীর মাধ্যমে তত্ত্বাবধায়ক সরকার পদ্ধতির প্রবর্তন করে সংসদ ভেঙে দেয়। তত্ত্বাবধায়কের গণদাবির জোয়ারে আওয়ামী লীগ সামান্য সংখ্যাগরিষ্ঠতায় কোনমতে ক্ষমতা লাভ করে। কিš‘ ঠিক বিএনপির ব্যর্থ অপকৌশলের মতো বিগত মেয়াদেও আওয়ামী লীগের অপকৌশলের ফলও নেতিবাচক হয়েছিল।
দেখা যা”েছ যে উভয় দলÑ বিএনপি ও আওয়ামী লীগ ব্যর্থ সরকার পরিচালনার পর তাদের নাজুক অব¯’া ঠিকই উপলব্ধি করে এবং তা কবুল করে শোধরানোর পথ খোঁজার পরিবর্তে অপকৌশলে লিপ্ত হয়। আওয়ামী লীগ এ মুহূর্তে সেটাই করছে। এরই মধ্যে আরেক সংশোধনীর মাধ্যমে দলটি তত্ত্বাবধায়ক সরকার প্রথা প্রত্যাহার করেছে। সেই আগের মেয়াদের ধাঁচেই প্রশাসন তাদের অনুকূলে বিন্যস্ত করেছে। আওয়ামী ক্যাডারদের যুক্ত করে গড়ে উঠেছে আইন-শৃংখলা রক্ষাবাহিনী। সব শিক্ষা-সাংস্কৃতিক প্রতিষ্ঠানে কৌশলে গড়ে তোলা হয়েছে বিশাল স্তাবক-গোষ্ঠী, যাদের কাজই হল মাননীয় প্রধানমন্ত্রী ও তার পরিবারকে মহিমান্বিত করা। সরকার থেকে প্রদত্ত উ”িছষ্টের বিনিময়ে এরা সরকারের পক্ষেই কাজ করবে বলে ধরে নেয়া যায়। কিছুটা অন্যরকমভাবে বিএনপিও প্রশাসনের রাজনীতিকরণ ছাড়াও শিক্ষা-সাংস্কৃতিক অঙ্গনে তাদের প্রভাব বিস্তার করেছিল।
কিš‘ অভিজ্ঞতায় দেখা যায়, এ কৌশল শেষ পর্যন্ত টেকে না। কেননা উ”িছষ্ট ভাগাভাগির লড়াইয়ে এরা অন্তর্দ্বন্দ্বে জড়িয়ে পড়ে। তাছাড়া যারা সুবিধাভোগী মোসাহেব, তারা তো আসলে মৌসুমি পাখি। মৌসুম ফুরিয়ে গেলে তারাও অন্তর্হিত হয়। অতীতে আওয়ামী লীগসংশ্লিষ্টদের দেখেছি দল ক্ষমতা থেকে বিতাড়িত হলেই এরা কোথায় যেন হারিয়ে যায়। সরীসৃপের মতো জড়-নিষ্ক্রিয় অব¯’ায় পড়ে থাকে। এখন যারা নেতানেত্রীদের ঘিরে স্তাবকতায় মত্ত তাদের আর ক্ষমতাহীন দলের জন্য মাঠে-ময়দানের রাজনীতিতে খুঁজে পাওয়া যাবে না। বঙ্গবন্ধু হত্যার পর এমনই দেখা গিয়েছিল। আমার মনে আছে, বঙ্গবন্ধুর রাজনৈতিক সাফল্য যখন মধ্যগগনে, যে কেউ যে কোনভাবে বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে সম্পৃক্ততা প্রদর্শনে তাদের সংরক্ষিত সামান্যতম প্রমাণও উপ¯’াপন করতে প্রাণপণ চেষ্টা করত।
আবার ঠিক উল্টো চেষ্টা দেখেছি তার নিহত হওয়ার পর। কোনদিন কোনক্রমে বঙ্গবন্ধুর সংস্পর্শে এসে থাকলেও সেই ‘অনভিপ্রেত’ স্মৃতি মুছে ফেলার প্রাণান্তকর চেষ্টা। এখন আবার হিসাব করে রাজনীতি করার যুগ এসেছে যাকে বলে ‘রিয়ালপলিটিকে’র সময়। এখন তো পাওনা অগ্রিম বুঝে নিয়েই নবাগতরা রাজনীতির মাঠে পা বাড়ায়।
আওয়ামী তথা মহাজোটের যে আপাতত গ্রহণযোগ্যতায় ধস নেমেছে তা শুধু আন্তর্জাতিকভাবেই স্বীকৃত বা প্রচারিত নয়, দেশের অভ্যন্তরে চোখ-কান খোলা রাখলেই তা বোঝা যায়। পথ চলতে রিকশাওয়ালার সঙ্গে কথা বা গ্রামগঞ্জে টংয়ের আড্ডায় সমবেত লোকজন কী বলেন, সেদিকে মনোযোগী হলেই আওয়ামীদের কীর্তিকাহিনীর ফিরিস্তি ও জনমনে তাদের অব¯’ান সম্বন্ধে জানা যায়। আর মিডিয়া তো আছেই। মিডিয়ার সংবাদদাতা, বিশ্লেষক ও প্রতিবেদকরা একটি অসাধারণ শ্রেণী। সাহসী, মেধাবী ও তথ্যসমৃদ্ধ। তারাও জনগণকে সরকারের কীর্তিকাহিনী সম্বন্ধে জানাতে সাহায্য করেন।
এটি একটি কমনসেন্সের ব্যাপার, যে সরকার সাড়ে তিন বছর চলেছে বা এখনও চলছে তার সম্বন্ধে জনগণ কী ধারণা পোষণ করবে। যে প্রাক-নির্বাচন সাজে আওয়ামী লীগ সরকারকে সাজিয়েছে তাতে এরই মধ্যে আওয়ামীদের জন্য কারচুপির ক্ষেত্র তৈরি হয়ে আছে।
এরপর সেই ক্ষেত্র ভোট চুরির জন্য আরও উর্বর হবে ভয়ভীতি প্রদর্শনের মাধ্যমে, যার প্র¯‘তি সমানে চলেছে। চলেছে এক দানবীয় দমননীতি। বিরোধী দলের সব শীর্ষ নেতার ওপর ঠুকে দেয়া হয়েছে অ-জামিনযোগ্য বিস্ফোরক মামলা, যাতে হাবুডুবু খা”েছন দলের অন্য নেতাকর্মীরা। এই নাকি একটি দেশের গণতান্ত্রিক নির্বাচনের পটভূমি? কেউ স্বাধীনভাবে কথা বলতে পারবে না, জনমত গঠন করতে পারবে না বা অন্যায়ের প্রতিবাদ করতে পারবে না। করলেই ঠুকে দেয়া হবে মামলা। লেলিয়ে দেয়া হবে পুলিশ, যাদের নির্যাতনে নির্বাচনের মাঠ ছাড়বে বিরোধীরা।
সংবাদপত্রে পড়ি পুলিশ-আতংকের কথা। কথা তো ছিল পুলিশ হবে আমাদের বন্ধু। তাদের আতংকের ব¯‘তে পরিণত করা হয়েছে। এর চেয়ে দুর্ভাগ্য আর কী হতে পারে! পুলিশ কী না পারেÑ গুম, অপহরণ, প্রয়োজনে হত্যা। এমনিভাবেই রাজনীতিকরা তাদের ব্যবহার করেছেন! আরও হতাশাব্যঞ্জক পুলিশের সম্বন্ধে তাদের মন্ত্রীদের বচন। সবকিছু মিলিয়ে বর্তমান পরিবেশ অবশ্যই নির্বাচনবান্ধব নয়। এ পরিবেশে কোন গণতান্ত্রিক নির্বাচন হতে পারে না। নির্বাচন যে কোন গণতান্ত্রিক দেশে একটি উৎসব। এতে দেশের জনগণ, যারা সর্বক্ষণই অবদমিত, তারা স্বাধীন ও নিরপেক্ষভাবে ভয়ভীতির তোয়াক্কা না করে ভোট দেবে।
দেশের দুটি প্রধান রাজনৈতিক দলই পালাক্রমে দেশ ও সমাজের অনেক ক্ষতি করেছে। সবচেয়ে মারাÍক যে ক্ষতিটা করেছে তা হল জনগণের আশা ও আ¯’ার ভিতটাকে তারা গুঁড়িয়ে দিয়েছে। আমরা এখনও আশাবাদী হতে চাই। কিš‘ বর্তমান ধারার রাজনীতি তা হতে দেবে না। আওয়ামী লীগ আমাদের শুধু দুঃখ, দারিদ্র্য, বৈষম্য, দুর্নীতিই দিয়েছে, আরও দিয়েছে সীমাহীন দুর্ভোগ। বিএনপি এর চেয়ে ভালো কিছু দেবে, তারও সম্ভাবনা নেই।
জনগণ তাদের সান্ত্বনার জন্য নিরপেক্ষ একটি নির্বাচনের অপেক্ষায় তাকিয়ে আছে। এমন একটি নির্বাচন, যাকে ঘিরে ক্ষমতাসীনদের কারচুপি করার কোন সম্ভাবনা থাকবে না বা সরকারি দল প্রভাব খাটাতে পারবে না। দুঃখজনক যে, আওয়ামীরা উল্টো হাঁটা দিয়েছে এবং ক্ষমতা পুনর্দখলে মরিয়া হয়ে উঠেছে। কিš‘ তেমনটি ঘটাতে সক্ষম হলে একুশ শতকের বাংলাদেশে তারা তা কিছুতেই হালাল করতে পারবে না। আমি বলি না যে, আওয়ামীরা দেশের জন্য কিছুই করেনি। কিš‘ তাদের প্রতিশ্র“তির ক্ষুদ্র ভগ্নাংশও তাতে পূরণ হয়নি। তাহলে নবম সংসদ নির্বাচনের আগে কেন প্রতিশ্র“তির এত ফুলঝুরি? ঙহষু ঃড় ঃধশব ঃযব 
ঢ়বড়ঢ়ষব ভড়ৎ ধ ৎরফব? তবু আশা করতেই থাকব যে ভালো কিছু ঘটবে।
কিš‘ বর্তমানে ক্ষমতার দণ্ড যাদের হাতে তারা তো উঠেপড়ে লেগেছেন, জিততে তাদের হবেই। এ বাসনা সম্বন্ধে তাদের কোন রাখঢাক নেই। অনেক দিন আগে থেকেই আওয়ামীদের নির্বাচনী কাউন্ট-ডাউন শুর“ হয়েছে। তারই সমান্তরালে সক্রিয় করা হয়েছে আওয়ামীদের নির্বাচন পরিচালনা কমিটি। এ কমিটি তাদের ধানমণ্ডির অফিসে নির্বাচনী কৌশলগুলোকে শাণিত করছে। এর বিপরীতে প্রধান বিরোধী দল কোন নির্বাচনী ভাবনা তো দূরের কথা, এখনও কঠোর দমননীতির কবলে পর্যুদস্ত। বিএনপিবিরোধী অভিযোগ যথা সচিবালয়ে বিস্ফোরক নিক্ষেপ ও প্রধানমন্ত্রীর দফতরের সামনে গাড়ি পোড়ানো মামলায় গোয়েন্দা পুলিশ অতি দ্র“ততার সঙ্গে চার্জশিট দিয়েছে। এর অর্থ, কোন নির্বাচনী তৎপরতা থেকে বিরোধী দলকে বি”িছন্ন রাখা এবং এ সুযোগে প্রাক-নির্বাচনী তৎপরতায় ক্ষমতাসীনদের দৌড়ে এগিয়ে থাকা।
প্রাক-নির্বাচনী এ অপতৎপরতায় ক্ষমতাসীনদের ভূমিকায় প্রকটভাবে লক্ষণীয় সাংবাদিক নির্যাতন ও পুলিশনির্ভরতা। সাংবাদিকরা তাদের নিয়মিত প্রতিবেদনে জনসমক্ষে তুলে আনছেন সরকারের দ্বিমুখীনীতি, মেয়াদ শেষে অনুগতদের পারিতোষিক প্রদানে দুর্নীতির এক প্রকার মহোৎসবের কথা এবং প্রশাসনকে আপাদমস্তক রাজনীতিকরণের অজ্ঞাত কাহিনী। তারাই ফাঁস করে দি”েছন হাজারো অনিয়মের কথা, যার কারণে দেশ শাসনের নামে আওয়ামীদের গণ-লুটপাটের ম”ছব চলছে এখন। স্বভাবতই এসব কারণে সাংবাদিকরা এখন সরকারের চক্ষুশূল। তাই তাদের ওপর পুলিশ ছাড়াও অজ্ঞাত অপরাধীদের চোরাগোপ্তা ও অতর্কিত হামলা। সাগর-র“নী এপিসড তো রহস্যই থেকে গেল। স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর ভাষ্য অনুযায়ী, তদন্ত শেষ না হওয়া পর্যন্ত সাগর-র“নী বা ইলিয়াস আলী সম্বন্ধে কিছুই বলা যাবে না।
আমরা জনগণ এখনও সরকারের ভালোত্বে বিশ্বাস করতে চাই, এ দেশের অমিত সম্ভাবনায় আ¯’া রাখতে চাই। পুলিশের ‘দুষ্টের দমন ও শিষ্টের লালনে’ বিশ্বাস রাখতে চাই, কারণ তারা তো এ দেশেরই সন্তান। বিশ্বাস রাখতে চাই যে, এ দেশ একদিন দুর্নীতিমুক্ত হবে, দারিদ্র্যমুক্ত হবে এবং আর্থ-সামাজিক সমতার নিদর্শন হবে। কিš‘ আফসোস, সরকারের অব্যাহত অপকর্মে সেই বিশ্বাসগুলো ক্রমেই বিলীন হয়ে যা”েছ।
স্বাধীনতার চার দশক পরে ব্যক্তিজীবনে প্রৌঢ়ত্বের দ্বারপ্রান্তে এসে এই বাংলায় যা আমাকে লালন করেছে, স্বপ্ন দেখিয়েছে এবং আশায় বুক বাঁধতে শিখিয়েছে, সেই মাতৃভূমিকে জড়িয়ে কাঁদতে ই”েছ করে এবং এ দেশের রাজনীতির নামে লুণ্ঠনকারীদের বলতে ই”েছ করে : চাইলে সবকিছু লুটেপুটে নাও কিš‘ আমাদের আশা ও বিশ্বাসের ভিতকে দোহাই লাগে, তোমরা ভেঙো না!
এম আবদুল হাফিজ : নিরাপত্তা বিশ্লেষক, কলাম লেখক