এম আবদুল হাফিজ
ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ নেতৃত্বাধীন মহাজোটের জনপ্রিয়তা কমেছে, তবে ঠিক কতটা কমেছে তা শুধু আগামী সাধারণ নির্বাচনে বোঝা যাবে। সমস্যা যে, একথা কবুল করতেও ক্ষমতাসীনদের অনীহা। বিগত যৌবন নর-নারী যেমন নানাভাবে তাদের যৌবনকে অপরিবর্তিত দেখানোর চেষ্টা করে, তেমনি মহাজোট বিশেষ করে আওয়ামী লীগ তাদের জনপ্রিয়তা অক্ষত রাখার সার্টিফিকেট সংগ্রহে ব্যস্ত। কিছুদিন আগে কোথায় না কোথায় প্রকাশিত যুক্তরাষ্ট্রের গ্যালাপ জরিপে প্রধানমন্ত্রীর জনপ্রিয়তার শীর্ষ অব¯’ান নিয়ে শেখ হাসিনা গণভবনে তার নিয়মিত মিথষ্ক্রিয়ায় গর্বও করেছেন, যদিও আমরা এ দেশবাসী ভিন্ন চিত্র দেখছি। দেখছি আওয়ামীদের জনপ্রিয়তা তথা ক্ষমতা ধরে রাখার প্রাণান্ত প্রচেষ্টা। যদিও সে সম্ভাবনা ক্রমেই ক্ষীণ হয়ে আসছে।
আওয়ামীরা তাদের ছিয়ানব্বইয়ের মেয়াদ শেষেও অনেক কূটকৌশল এঁটেছিল। তৎকালীন রাষ্ট্রপতি বিচারপতি সাহাবুদ্দীন তাদের কিছু অনৈতিক আবদার মেনে না নেয়ায় তার সঙ্গে আওয়ামীদের মনোমালিন্যও হয়েছিল, যা শেষ পর্যন্ত তিক্ততায়ও পর্যবসিত হয়। এতদসত্ত্বেও ‘জনতার মঞ্চ’ ইত্যাদির মাধ্যমে অর্জিত তত্ত্বাবধায়ক সরকার তখন বহাল থাকা সত্ত্বেও আওয়ামী লীগ পরবর্তী নির্বাচনে (২০০১ সাল) পুনর্নির্বাচিত হওয়া সম্বন্ধে নিশ্চিত হতে পারেনি। তাই তারা বিচারপতি সাহাবুদ্দীনের শরণাপন্ন হয়েছিল প্রশাসনিক বেশ কিছু বিন্যাসের জন্য, যা নির্বাচনকে তাদের অনুকূলে প্রভাবান্বিত করবে।
অবশ্য এমন অপকর্ম বিএনপিও করেছিল যা বিরোধীদের তত্ত্বাবধায়ক আন্দোলনকে উসকে দিয়েছিল। একতরফাভাবে দলটি বিচারপতি সাদেককে প্রধান নির্বাচন কমিশনার নিয়োগ দিয়েছিল। উদ্দেশ্য একই, নির্বাচনকে প্রভাবান্বিত করা। প্রবল আন্দোলনের মুখে একটি প্রহসনের নির্বাচন হলেও এবং বিএনপি তাতে জিতলেও ওই ‘নির্বাচিত’ সরকার তড়িঘড়ি সংসদে ত্রয়োদশ সংশোধনীর মাধ্যমে তত্ত্বাবধায়ক সরকার পদ্ধতির প্রবর্তন করে সংসদ ভেঙে দেয়। তত্ত্বাবধায়কের গণদাবির জোয়ারে আওয়ামী লীগ সামান্য সংখ্যাগরিষ্ঠতায় কোনমতে ক্ষমতা লাভ করে। কিš‘ ঠিক বিএনপির ব্যর্থ অপকৌশলের মতো বিগত মেয়াদেও আওয়ামী লীগের অপকৌশলের ফলও নেতিবাচক হয়েছিল।
দেখা যা”েছ যে উভয় দলÑ বিএনপি ও আওয়ামী লীগ ব্যর্থ সরকার পরিচালনার পর তাদের নাজুক অব¯’া ঠিকই উপলব্ধি করে এবং তা কবুল করে শোধরানোর পথ খোঁজার পরিবর্তে অপকৌশলে লিপ্ত হয়। আওয়ামী লীগ এ মুহূর্তে সেটাই করছে। এরই মধ্যে আরেক সংশোধনীর মাধ্যমে দলটি তত্ত্বাবধায়ক সরকার প্রথা প্রত্যাহার করেছে। সেই আগের মেয়াদের ধাঁচেই প্রশাসন তাদের অনুকূলে বিন্যস্ত করেছে। আওয়ামী ক্যাডারদের যুক্ত করে গড়ে উঠেছে আইন-শৃংখলা রক্ষাবাহিনী। সব শিক্ষা-সাংস্কৃতিক প্রতিষ্ঠানে কৌশলে গড়ে তোলা হয়েছে বিশাল স্তাবক-গোষ্ঠী, যাদের কাজই হল মাননীয় প্রধানমন্ত্রী ও তার পরিবারকে মহিমান্বিত করা। সরকার থেকে প্রদত্ত উ”িছষ্টের বিনিময়ে এরা সরকারের পক্ষেই কাজ করবে বলে ধরে নেয়া যায়। কিছুটা অন্যরকমভাবে বিএনপিও প্রশাসনের রাজনীতিকরণ ছাড়াও শিক্ষা-সাংস্কৃতিক অঙ্গনে তাদের প্রভাব বিস্তার করেছিল।
কিš‘ অভিজ্ঞতায় দেখা যায়, এ কৌশল শেষ পর্যন্ত টেকে না। কেননা উ”িছষ্ট ভাগাভাগির লড়াইয়ে এরা অন্তর্দ্বন্দ্বে জড়িয়ে পড়ে। তাছাড়া যারা সুবিধাভোগী মোসাহেব, তারা তো আসলে মৌসুমি পাখি। মৌসুম ফুরিয়ে গেলে তারাও অন্তর্হিত হয়। অতীতে আওয়ামী লীগসংশ্লিষ্টদের দেখেছি দল ক্ষমতা থেকে বিতাড়িত হলেই এরা কোথায় যেন হারিয়ে যায়। সরীসৃপের মতো জড়-নিষ্ক্রিয় অব¯’ায় পড়ে থাকে। এখন যারা নেতানেত্রীদের ঘিরে স্তাবকতায় মত্ত তাদের আর ক্ষমতাহীন দলের জন্য মাঠে-ময়দানের রাজনীতিতে খুঁজে পাওয়া যাবে না। বঙ্গবন্ধু হত্যার পর এমনই দেখা গিয়েছিল। আমার মনে আছে, বঙ্গবন্ধুর রাজনৈতিক সাফল্য যখন মধ্যগগনে, যে কেউ যে কোনভাবে বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে সম্পৃক্ততা প্রদর্শনে তাদের সংরক্ষিত সামান্যতম প্রমাণও উপ¯’াপন করতে প্রাণপণ চেষ্টা করত।
আবার ঠিক উল্টো চেষ্টা দেখেছি তার নিহত হওয়ার পর। কোনদিন কোনক্রমে বঙ্গবন্ধুর সংস্পর্শে এসে থাকলেও সেই ‘অনভিপ্রেত’ স্মৃতি মুছে ফেলার প্রাণান্তকর চেষ্টা। এখন আবার হিসাব করে রাজনীতি করার যুগ এসেছে যাকে বলে ‘রিয়ালপলিটিকে’র সময়। এখন তো পাওনা অগ্রিম বুঝে নিয়েই নবাগতরা রাজনীতির মাঠে পা বাড়ায়।
আওয়ামী তথা মহাজোটের যে আপাতত গ্রহণযোগ্যতায় ধস নেমেছে তা শুধু আন্তর্জাতিকভাবেই স্বীকৃত বা প্রচারিত নয়, দেশের অভ্যন্তরে চোখ-কান খোলা রাখলেই তা বোঝা যায়। পথ চলতে রিকশাওয়ালার সঙ্গে কথা বা গ্রামগঞ্জে টংয়ের আড্ডায় সমবেত লোকজন কী বলেন, সেদিকে মনোযোগী হলেই আওয়ামীদের কীর্তিকাহিনীর ফিরিস্তি ও জনমনে তাদের অব¯’ান সম্বন্ধে জানা যায়। আর মিডিয়া তো আছেই। মিডিয়ার সংবাদদাতা, বিশ্লেষক ও প্রতিবেদকরা একটি অসাধারণ শ্রেণী। সাহসী, মেধাবী ও তথ্যসমৃদ্ধ। তারাও জনগণকে সরকারের কীর্তিকাহিনী সম্বন্ধে জানাতে সাহায্য করেন।
এটি একটি কমনসেন্সের ব্যাপার, যে সরকার সাড়ে তিন বছর চলেছে বা এখনও চলছে তার সম্বন্ধে জনগণ কী ধারণা পোষণ করবে। যে প্রাক-নির্বাচন সাজে আওয়ামী লীগ সরকারকে সাজিয়েছে তাতে এরই মধ্যে আওয়ামীদের জন্য কারচুপির ক্ষেত্র তৈরি হয়ে আছে।
এরপর সেই ক্ষেত্র ভোট চুরির জন্য আরও উর্বর হবে ভয়ভীতি প্রদর্শনের মাধ্যমে, যার প্র¯‘তি সমানে চলেছে। চলেছে এক দানবীয় দমননীতি। বিরোধী দলের সব শীর্ষ নেতার ওপর ঠুকে দেয়া হয়েছে অ-জামিনযোগ্য বিস্ফোরক মামলা, যাতে হাবুডুবু খা”েছন দলের অন্য নেতাকর্মীরা। এই নাকি একটি দেশের গণতান্ত্রিক নির্বাচনের পটভূমি? কেউ স্বাধীনভাবে কথা বলতে পারবে না, জনমত গঠন করতে পারবে না বা অন্যায়ের প্রতিবাদ করতে পারবে না। করলেই ঠুকে দেয়া হবে মামলা। লেলিয়ে দেয়া হবে পুলিশ, যাদের নির্যাতনে নির্বাচনের মাঠ ছাড়বে বিরোধীরা।
সংবাদপত্রে পড়ি পুলিশ-আতংকের কথা। কথা তো ছিল পুলিশ হবে আমাদের বন্ধু। তাদের আতংকের ব¯‘তে পরিণত করা হয়েছে। এর চেয়ে দুর্ভাগ্য আর কী হতে পারে! পুলিশ কী না পারেÑ গুম, অপহরণ, প্রয়োজনে হত্যা। এমনিভাবেই রাজনীতিকরা তাদের ব্যবহার করেছেন! আরও হতাশাব্যঞ্জক পুলিশের সম্বন্ধে তাদের মন্ত্রীদের বচন। সবকিছু মিলিয়ে বর্তমান পরিবেশ অবশ্যই নির্বাচনবান্ধব নয়। এ পরিবেশে কোন গণতান্ত্রিক নির্বাচন হতে পারে না। নির্বাচন যে কোন গণতান্ত্রিক দেশে একটি উৎসব। এতে দেশের জনগণ, যারা সর্বক্ষণই অবদমিত, তারা স্বাধীন ও নিরপেক্ষভাবে ভয়ভীতির তোয়াক্কা না করে ভোট দেবে।
দেশের দুটি প্রধান রাজনৈতিক দলই পালাক্রমে দেশ ও সমাজের অনেক ক্ষতি করেছে। সবচেয়ে মারাÍক যে ক্ষতিটা করেছে তা হল জনগণের আশা ও আ¯’ার ভিতটাকে তারা গুঁড়িয়ে দিয়েছে। আমরা এখনও আশাবাদী হতে চাই। কিš‘ বর্তমান ধারার রাজনীতি তা হতে দেবে না। আওয়ামী লীগ আমাদের শুধু দুঃখ, দারিদ্র্য, বৈষম্য, দুর্নীতিই দিয়েছে, আরও দিয়েছে সীমাহীন দুর্ভোগ। বিএনপি এর চেয়ে ভালো কিছু দেবে, তারও সম্ভাবনা নেই।
জনগণ তাদের সান্ত্বনার জন্য নিরপেক্ষ একটি নির্বাচনের অপেক্ষায় তাকিয়ে আছে। এমন একটি নির্বাচন, যাকে ঘিরে ক্ষমতাসীনদের কারচুপি করার কোন সম্ভাবনা থাকবে না বা সরকারি দল প্রভাব খাটাতে পারবে না। দুঃখজনক যে, আওয়ামীরা উল্টো হাঁটা দিয়েছে এবং ক্ষমতা পুনর্দখলে মরিয়া হয়ে উঠেছে। কিš‘ তেমনটি ঘটাতে সক্ষম হলে একুশ শতকের বাংলাদেশে তারা তা কিছুতেই হালাল করতে পারবে না। আমি বলি না যে, আওয়ামীরা দেশের জন্য কিছুই করেনি। কিš‘ তাদের প্রতিশ্র“তির ক্ষুদ্র ভগ্নাংশও তাতে পূরণ হয়নি। তাহলে নবম সংসদ নির্বাচনের আগে কেন প্রতিশ্র“তির এত ফুলঝুরি? ঙহষু ঃড় ঃধশব ঃযব
ঢ়বড়ঢ়ষব ভড়ৎ ধ ৎরফব? তবু আশা করতেই থাকব যে ভালো কিছু ঘটবে।
কিš‘ বর্তমানে ক্ষমতার দণ্ড যাদের হাতে তারা তো উঠেপড়ে লেগেছেন, জিততে তাদের হবেই। এ বাসনা সম্বন্ধে তাদের কোন রাখঢাক নেই। অনেক দিন আগে থেকেই আওয়ামীদের নির্বাচনী কাউন্ট-ডাউন শুর“ হয়েছে। তারই সমান্তরালে সক্রিয় করা হয়েছে আওয়ামীদের নির্বাচন পরিচালনা কমিটি। এ কমিটি তাদের ধানমণ্ডির অফিসে নির্বাচনী কৌশলগুলোকে শাণিত করছে। এর বিপরীতে প্রধান বিরোধী দল কোন নির্বাচনী ভাবনা তো দূরের কথা, এখনও কঠোর দমননীতির কবলে পর্যুদস্ত। বিএনপিবিরোধী অভিযোগ যথা সচিবালয়ে বিস্ফোরক নিক্ষেপ ও প্রধানমন্ত্রীর দফতরের সামনে গাড়ি পোড়ানো মামলায় গোয়েন্দা পুলিশ অতি দ্র“ততার সঙ্গে চার্জশিট দিয়েছে। এর অর্থ, কোন নির্বাচনী তৎপরতা থেকে বিরোধী দলকে বি”িছন্ন রাখা এবং এ সুযোগে প্রাক-নির্বাচনী তৎপরতায় ক্ষমতাসীনদের দৌড়ে এগিয়ে থাকা।
প্রাক-নির্বাচনী এ অপতৎপরতায় ক্ষমতাসীনদের ভূমিকায় প্রকটভাবে লক্ষণীয় সাংবাদিক নির্যাতন ও পুলিশনির্ভরতা। সাংবাদিকরা তাদের নিয়মিত প্রতিবেদনে জনসমক্ষে তুলে আনছেন সরকারের দ্বিমুখীনীতি, মেয়াদ শেষে অনুগতদের পারিতোষিক প্রদানে দুর্নীতির এক প্রকার মহোৎসবের কথা এবং প্রশাসনকে আপাদমস্তক রাজনীতিকরণের অজ্ঞাত কাহিনী। তারাই ফাঁস করে দি”েছন হাজারো অনিয়মের কথা, যার কারণে দেশ শাসনের নামে আওয়ামীদের গণ-লুটপাটের ম”ছব চলছে এখন। স্বভাবতই এসব কারণে সাংবাদিকরা এখন সরকারের চক্ষুশূল। তাই তাদের ওপর পুলিশ ছাড়াও অজ্ঞাত অপরাধীদের চোরাগোপ্তা ও অতর্কিত হামলা। সাগর-র“নী এপিসড তো রহস্যই থেকে গেল। স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর ভাষ্য অনুযায়ী, তদন্ত শেষ না হওয়া পর্যন্ত সাগর-র“নী বা ইলিয়াস আলী সম্বন্ধে কিছুই বলা যাবে না।
আমরা জনগণ এখনও সরকারের ভালোত্বে বিশ্বাস করতে চাই, এ দেশের অমিত সম্ভাবনায় আ¯’া রাখতে চাই। পুলিশের ‘দুষ্টের দমন ও শিষ্টের লালনে’ বিশ্বাস রাখতে চাই, কারণ তারা তো এ দেশেরই সন্তান। বিশ্বাস রাখতে চাই যে, এ দেশ একদিন দুর্নীতিমুক্ত হবে, দারিদ্র্যমুক্ত হবে এবং আর্থ-সামাজিক সমতার নিদর্শন হবে। কিš‘ আফসোস, সরকারের অব্যাহত অপকর্মে সেই বিশ্বাসগুলো ক্রমেই বিলীন হয়ে যা”েছ।
স্বাধীনতার চার দশক পরে ব্যক্তিজীবনে প্রৌঢ়ত্বের দ্বারপ্রান্তে এসে এই বাংলায় যা আমাকে লালন করেছে, স্বপ্ন দেখিয়েছে এবং আশায় বুক বাঁধতে শিখিয়েছে, সেই মাতৃভূমিকে জড়িয়ে কাঁদতে ই”েছ করে এবং এ দেশের রাজনীতির নামে লুণ্ঠনকারীদের বলতে ই”েছ করে : চাইলে সবকিছু লুটেপুটে নাও কিš‘ আমাদের আশা ও বিশ্বাসের ভিতকে দোহাই লাগে, তোমরা ভেঙো না!
এম আবদুল হাফিজ : নিরাপত্তা বিশ্লেষক, কলাম লেখক