শনিবার, ২৩ জুন, ২০১২

পারস্পরিক অপরিহার্যতাই পাক মার্কিন মৈত্রীর নেপথ্য শক্তি




এম আবদুল হাফিজ
২০১১ সালের ২২ সেপ্টেম্বর মার্কিন জয়েন্ট চিফস অব স্টাফের তৎকালীন চেয়ারম্যান অ্যাডমিরাল মাইক মুলেন ওই পদে থাকা অব¯’ায় শেষবারের মতো সিনেট আর্মড ফোর্সেস কমিটির মুখোমুখি হন। সেখানে তার বক্তব্যে তিনি অশিষ্টভাবে পাকিস্তানের সমালোচনা করেন। তিনি কমিটিকে স্পষ্টই বলেন, উগ্রবাদী ধর্মীয় সংগঠনগুলো কার্যত সেখানকার সরকারের হয়েই আফগান সৈন্য এবং বেসামরিক লোকজনসহ মার্কিন সৈন্যদের ওপরও হামলা চালিয়ে যা”েছ। হাক্কানি নেটওয়ার্ক সম্বন্ধে তিনি বলেন, ওটি আসলে গোয়েন্দা সং¯’া আইএসআইরই একটি কৌশলগত শাখা। মুলেন প্রদত্ত তথ্য অনুযায়ী এ নেটওয়ার্ক ২০১১ সালের জুন মাসে কাবুলের ইন্টারকন্টিনেন্টাল হোটেলে আক্রমণ চালায়। অতঃপর বছরের সেপ্টেম্বরে ওয়ার্দাক প্রদেশে ট্রাক-বোমার হামলা এবং সে মাসেই কাবুলে মার্কিন দূতাবাসে সন্ত্রাসী হামলা চালায়। 
এত কিছু বলার পরও মুলেন প্রত্যাশিত উপসংহারে আসেননি। পাকিস্তানের বির“দ্ধে এমন একগাদা অভিযোগ থাকা সত্ত্বেও মুলেন একথা বলা থেকে বিরত থাকেন যে, ‘পাকিস্তানকে একটি বৈরী শক্তি হিসেবে শনাক্ত করা হোক’। বরং মুলেনের সাক্ষ্য-প্রমাণের ক’দিন পর আবার আগের মতো পাকিস্তান ও যুক্তরাষ্ট্র উভয়েই তাদের সন্ত্রাসবিরোধী যুদ্ধে তথাকথিত সহযোগিতা বা তার ভান করতে স্ব স্ব ভূমিকায় ফিরে যায়। অর্থাৎ কেউ কাউকে বিশ্বাস না করেও আগের মতো পরস্পরের ‘সহযোগিতা’ করতে থাকে। এর কারণ যুক্তরাষ্ট্র জানে, পাকিস্তান ছাড়া তাদের গত্যন্তর নেই। যেমন পাকিস্তানও জানে যে, যতই অপ্রিয় হোক মার্কিন সাহায্য ছাড়া তারা অচল। 
যুগ যুগ ধরে মার্কিনিরা পাকিস্তানি সাহায্যকে খরিদ করেছে। শুধু এক-এগারোর পরই পাকিস্তানকে প্রদত্ত মার্কিন সাহায্যের পরিমাণ ২০ বিলিয়ন ডলার। এটাই শুধু পাকিস্তানি সহযোগিতার মূল্য নয়, সেই সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্র পাকিস্তানকে অজস্র প্রশংসায় ধন্য করেছে। ২০০৭ সালে মুলেন জয়েন্ট চিফস অব স্টাফে নিয়োগ পাওয়ার পর ইসলামাবাদে তার প্রথম সংবাদ সম্মেলনে পাকিস্তানকে ‘অটল ঐতিহাসিক মিত্র’ বলে অভিহিত করেছিলেন। ২০০৮ সালে মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী কন্ডোলিৎসা রাইস পাকিস্তান সম্বন্ধে বলেছিলেন, ‘এটি এমন একটি দেশ যা সন্ত্রাসের সঙ্গে যুক্ত হওয়া তো দূরের কথা, বরং যেখানেই সন্ত্রাসের গন্ধ পাওয়া যায়, সেখানেই এই দানবের বির“দ্ধে লড়ে আসছে। 
ইত্যবসরে মার্কিন নেতৃত্ব পাকিস্তানি নেতৃত্বের সঙ্গে মিথষ্ক্রিয়ায় অনানুপাতিক সময়ও ব্যয় করেছে। পররাষ্ট্রমন্ত্রী হিসেবে হিলারি ক্লিনটন ভারতে দু’বারের বিপরীতে চারবার পাকিস্তান সফর করেছেন। অ্যাডমিরাল মুলেন বিশ বিশবার পাকিস্তানে এসেছেন। এতদসত্ত্বেও পাকিস্তানের বির“দ্ধে কুৎসায় মুলেনই প্রথম ব্যক্তি নন এবং তিনি ওই ভূমিকায় সর্বশেষও হবেন না। ২০০৮ সালে সিআইএ কাবুলে ভারতীয় দূতাবাসে বোমা হামলার জন্য পাকিস্তানকে দেষী করেছিল। ২০১১ সালে এবোটাবাদে ওসামা বিন লাদেনের আস্তানায় নেভি সিলস কমান্ডোদের হামলার মাত্র দু’মাস পর অ্যাডমিরাল জেম্স্ উইন ফিল্ড জয়েন্ট চিফসের ভাইস চেয়ারম্যান হিসেবে সিনেটের আর্মড ফোর্সেস কমিটিতে সাক্ষ্য দানকালে পাকিস্তানকে অত্যন্ত জটিল পার্টনার বা সহযোগী বলেছিলেন। ওই বছরেই হিলারি ক্লিনটন এক সংবাদ সম্মেলনে আফগান প্রেসিডেন্ট হামিদ কারজাইয়ের উপ¯ি’তিতে বলেছিলেন, ওবামা প্রশাসন পাকিস্তানিদের জোর-ধাক্কা দিয়ে সহযোগিতায় সক্রিয় করতে চেয়েছিল। তাই তা ফল বয়ে আনুক বা না আনুক, ওয়াশিংটনের পাকিস্তানকে সমালোচনা এবং সঙ্গে কিছু সাহায্যের থলি আসলে সন্ত্রাসবিরোধী যুদ্ধের কৌশলের অংশ, কিš‘ সে কৌশল সামান্যই সফল হয়েছে। ভয়ভীতি প্রদর্শন বা সমালোচনায় পাকিস্তানে কোন কাজ হয় না, কারণ ইসলামাবাদের নেতারা ভয়ভীতির ঊর্ধ্বে। কেননা যুক্তরাষ্ট্রই যে পাকিস্তানকে ভয় করে, এর কিছু ঘটনা অজ্ঞাত থাকেনি। মার্কিনিদের বিশ্বাস, পাকিস্তানি নীতি সাহায্যকারী না হলেও তা আরও খারাপ হতে পারত। ওয়াশিংটন এক রকম ধরেই নিয়েছে, যুক্তরাষ্ট্র পাকিস্তানকে সঙ্গে না রাখলে এবং ইসলামাবাদ আফগানিস্তানে সব সহযোগিতা বন্ধ করে দিলে সেটা হবে মার্কিনিদের সন্ত্রাস প্রতিরোধ যুদ্ধের সমাপ্তি। 
আরও সমস্যা যেÑ যেমনটা চলমান ভাবনায় প্রকাশ পায়Ñ বাইরের কোন সাহায্য-সমর্থন ব্যতিরেকে রাষ্ট্র হিসেবে নড়বড়ে পাকিস্তানের ভেঙে পড়ার আশংকা। এমন অব¯’ার উদ্ভব হলে ইসলামাবাদে একটি উগ্রবাদী শাসনের আশংকা উড়িয়ে দেয়া যায় না। তা যদি হয়, স্বভাবতই সেক্ষেত্রে পাকিস্তান-যুক্তরাষ্ট্র মৈত্রী তো দূরের কথা, উভয়ের মধ্যে ক্ষীণতম সংযোগের সুযোগও হয়তো থাকবে না। আফগানিস্তানে মার্কিন সমর্থনপুষ্ট কারজাই সরকারের সঙ্গেও হয়তো পাকিস্তানের সম্পর্ক ছিন্ন হয়ে যাবে। ফলে সমগ্র অঞ্চলে অ¯ি’রতা ছড়িয়ে পড়বে। এমন অব¯’া এই অঞ্চলে যুক্তরাষ্ট্রের কায়েমি স্বার্থকে ক্ষুণœ করবে। শুধু তাই নয়, ইসলামাবাদকে উগ্রবাদীদের হাতে পড়তে দিলে এমনকি একটি পারমাণবিক যুদ্ধ অন্তত ভারত-পাকিস্তানের মধ্যে সংঘটিত হতে পারে। 
পাকিস্তান-মার্কিন মৈত্রী সমস্যা সংকুল হলেও এর অর্জনও কিš‘ একেবারে নগণ্য নয়। এতদিন ধরে পাকিস্তানই তো মার্কিন সৈন্যদের জন্য রসদ সামগ্রী পাকিস্তানি ভূখণ্ডের মধ্য দিয়ে সরবরাহের সুযোগ দিয়েছে। এখন ন্যাটো না হয় মধ্য এশিয়া ও র“শ বদন্যতায় বিকল্প সরবরাহের পথ খুঁজে পেয়েছে। কিš‘ নয়-এগারোর প্রথম প্রহরে পাকিস্তানই ঝুঁকি নিয়ে সন্ত্রাসবিরোধী যুদ্ধের অনুকূলে সরবরাহ পথ দেয়া ছাড়াও অনেক মূল্যবান ভূমিকা রেখেছে। অনেক শীর্ষ আল কায়দা নেতাকে পাকড়াও করে পাকিস্তান কর্তৃপক্ষ মার্কিনিদের হাতে তুলে দিয়েছে। নয়-এগারোর একজন পরিকল্পক খালিদ শেখ মুহম্মদকে পাকড়াও করতে পাকিস্তানের অবদান আছে। এছাড়া আফগানিস্তানে ড্রোন হামলার সূত্রপাতই হয়েছিল বেলুচিস্তানে পাকিস্তান প্রদত্ত ঘাঁটি থেকে। 
তবু পাকিস্তানে মার্কিন সাহায্যের সব অবদানই ম্লান হয়ে যায়, যখন অনেক বিষয়েই পাকিস্তানের জেদি অসহযোগিতা বিবেচনায় আনা হয়। ইতিমধ্যেই পাকিস্তানের দুর্নাম হয়েছে বিশ্বে সর্বাপেক্ষা মারাÍক পরমাণু বিস্তারের হোতা হিসেবে। পাকিস্তান কর্তৃপক্ষ তথাকথিত এ কিউ খান নেটওয়ার্কের মাধ্যমে ইরান, লিবিয়া ও উত্তর কোরিয়ায় অর্থের বিনিময়ে পারমাণবিক প্রযুক্তি পাচার করেছে বলে অভিযোগ আছে। 
পাকিস্তান আল কায়দা, তালেবান ইত্যাদি জঙ্গিগোষ্ঠীর বির“দ্ধাচারণ করলেও হাক্কানি নেটওয়ার্কসহ আফগান-তালেবান এবং হিজবে ইসলামীর মতো জঙ্গি গোষ্ঠীগুলোকে প্রকাশ্যে না হলেও সমর্থন করে। কারণ তাদের দিয়ে ভারতকে এবং কোয়ালিশন সেনাদেরও সন্ত্রাসী চাপে রাখা যায়। অনেক পাকিস্তানি কর্মকর্তা আবার ড্রোন হামলাকে উৎসাহিতও করে। তবে একাধিক কারণে বিন লাদেন হত্যা এবং পাকিস্তানি সার্বভৌমত্ব লংঘন করে মার্কিন কমান্ডোদের হেলিকপ্টারে পাকিস্তানে প্রবেশের ঘটনায় পাকিস্তানিরা ক্ষুব্ধ প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করেছে, যার জের এখনও চলছে। সিআইএ’র চর রেমন্ড লাহোরে দুই পাকিস্তানিকে হত্যা করা সত্ত্বেও তাকে যুক্তরাষ্ট্রে প্রেরণকে ঘিরে পাকিস্তানিদের মধ্যে অনেক অসন্তোষ আছে। সর্বোপরি পাকিস্তানেরই অংশ উপজাতীয় অঞ্চলে নির্বিচার মার্কিন ড্রোন হামলা এবং তাতে বেসামরিক নাগরিকদের মৃত্যু পাকিস্তানে এক প্রচণ্ড মার্কিনবিরোধী অনুভূতি সৃষ্টি করেছে, যা অব্যাহত আছে। 
তা সত্ত্বেও সব দিক বিচার করে পাক-মার্কিন মৈত্রী টিকে থাকবে। সেই পঞ্চাশের দশক থেকে পাকিস্তান যখন প্রথম আঙ্কল স্যামের আলিঙ্গনে ধরা দিয়েছিল, সেই থেকেই পাক-মার্কিন সম্পর্কে অনেক চড়াই-উৎরাই এসেছে এবং সেসব মোকাবেলা করেই আজও দু’দেশের মৈত্রী অনেক বিতর্কিত হয়েও টিকে আছে। এবং এই দীর্ঘদিনে উভয় দেশই পরস্পরের প্রতি এতটাই আসক্ত যে, যতই নড়বড়ে হোক একটি মৈত্রী বন্ধন পরস্পরের স্বার্থেই টিকে থাকবে। সন্ত্রাস মোকাবেলার জন্য যুক্তরাষ্ট্রের পাকিস্তানি ভূখণ্ড ও সামরিক বাহিনী যেমন প্রয়োজন, তেমনি লুটেপুটে খাওয়া এক কংকালসার পাকিস্তানের অস্তিত্বের জন্য একইভাবে দরকার মার্কিন সাহায্য ।
এম আবদুল হাফিজ : নিরাপত্তা বিশ্লেষক ও কলাম লেখক

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন