মঙ্গলবার, ১৯ জুন, ২০১২

মিসরে রাজনীতি এবং সামরিক বাহিনী

মিসরে রাজনীতি এবং সামরিক বাহিনী



॥ এম. আবদুল হাফিজ ॥

দেশে স্থিতিশীলতা আনয়নের একটি ঘোষিত লক্ষ্যে প্রেসিডেন্ট হোসনি মোবারকের পদত্যাগের পর গণতন্ত্রের পথ সুগম করতে এবং একটি বেসামরিক সরকারের কাক্সিত অধিষ্ঠানের লক্ষ্যে মিসরের হাইয়ার মিলিটারি কাউন্সিল ২০১১ সালের ১১ ফেব্রুয়ারি ক্ষমতা গ্রহণ করে। মিসরে বিক্ষোভকান্ত জনগণ সম্ভাব্য নৈরাজ্য এড়াতে তাদের ভূমিকাকে স্বাগত জানায়। তা ছাড়া আর্মি এমন কোনো আভাসও প্রদর্শন করেনি যে, তারা রাজনৈতিক দৃশ্যপট নিয়ন্ত্রণে আগ্রহী। এর চেয়ে কোনো ভালো বিকল্প না থাকায় মিলিটারি অনিচ্ছা সত্ত্বেও অন্তর্বর্তীকালের জন্য সর্বসম্মতিক্রমে শৃঙ্খলা ও স্থিতিশীলতা পুনর্বহালের দায়িত্ব নেয়। অনেক সময় অনেক স্থানেই অচলাবস্থা বা দেশ কোনো বিপদের মুখোমুখি হলে মিলিটারি সেই জট ভাঙতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকায় নেমেছে। এখন কি সেই একই মিলিটারি কোনো বেসামরিক ব্যক্তিত্বের প্রেসিডেন্সি পদাধিকারের বিরোধী? এর সর্বোত্তম উত্তর : অনেক কিছুর ওপর তা নির্ভরশীল।
মিসরের নেতৃস্থানীয়রা অনেক কিছুতেই মতভেদ পোষণ করে থাকেন। কিন্তু যে একটি বিষয়ে তাদের মতৈক্য রয়েছে তা হলোÑ মিসরকে আরব বিশ্বে অবশ্যই একটি কেন্দ্রীয় ভূমিকায় থাকতে হবে। ১৯৫২ সালে কর্নেল গামাল আবদেল নাসেরের সামরিক অভ্যুত্থান এবং তার বিপ্লবী কমান্ড কাউন্সিলের একটি র‌্যাডিক্যাল জাতীয়তাবাদী পূর্বাভিমুখীনতা (Orientation) কোটি কোটি আরবকে আকর্ষণ করেছিল এবং সিরিয়া, ইরাক, লিবিয়া, সুদান ও ইয়েমেনে পরবর্তীকালে অভ্যুত্থানের মডেল হিসেবে কাজ করেছিল।
সেই সময় থেকেই মিসরের অভ্যন্তরীণ বা বৈদেশিক নীতিতে আমূল পরিবর্তন হলেও যা নাসেরের সময় থেকেই অপরিবর্তিত থেকে যায়, তা হলোÑ দেশটি সব সময়েই একজন সামরিক প্রেক্ষাপটের প্রেসিডেন্ট দ্বারা শাসিত হয়েছে। শুধু তাই নয়, সেই প্রেসিডেন্ট আবার সশস্ত্র বাহিনীর ওপর নির্ভর করেছেন তার সমর্থনের, গ্রহণযোগ্যতার ও বৈধতার জন্য। জাতীয় জীবনের সন্ধিক্ষণসমূহে মিলিটারির কর্তৃত্ববাদী নিয়ন্ত্রণ সরকারের টিকে থাকার জন্য গুরুত্বপূর্ণ প্রমাণিত হয়েছে।
১৯৫২ সালে মিসরে মিলিটারি ক্ষমতা গ্রহণের পর রাজনৈতিক দলগুলোকে নিষিদ্ধ করা হয়। সব গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত গ্রহণ করতে থাকে বিপ্লবী কমান্ড কাউন্সিল। সামরিক কর্মকর্তারাই প্রধান সরকারি পদগুলো অলঙ্কৃত করেন। তারাই হয়ে পড়েন দেশের কৌশলগত সংখ্যালঘিষ্ঠ গোষ্ঠী, যার অন্তর্ভুক্ত হন প্রেসিডেন্ট, ভাইস প্রেসিডেন্ট, প্রধানমন্ত্রী ও অন্যান্য গুরুত্বপূর্ণ মন্ত্রী। তাদের মধ্য থেকেই নিযুক্ত হন সেনাপ্রধান, জাতীয় নিরাপত্তা প্রধান, ক্ষমতাসীন দলের প্রধান, এমনকি বিচার বিভাগের চেয়ারম্যান। এক কথায়, এতে উদ্ভব ঘটে একপ্রকারের প্রেসিডেন্টসিয়াল রাজতন্ত্র। এটি মিলিটারি বোনাপার্টিজমের মিসরীয় সংস্করণ। মজার কথা, সামরিক নেতৃত্ব কোনো জবাবদিহিতায় বিশ্বাস করে না বা গ্রহণ করে না। তাদের ওপর নেই কোনো বেসামরিক নিয়ন্ত্রণ।
১৯৬৭ সালে ছ’দিনের আরব-ইসরাইল যুদ্ধে মিসরের শোচনীয় পরাজয় ছিল মিলিটারির রাজনৈতিক ভূমিকায় একটি টার্নিং পয়েন্ট। খোদ মিলিটারির জবাবদিহিতা নিয়ে উচ্চকণ্ঠ স্লোগান উত্থিত হয়েছিল। তখন মিসরের যে জনগণকে ওই অঞ্চলের সবচেয়ে শক্তিশালী সেনাবাহিনীর প্রতিশ্রুতি দেয়া হয়েছিল, তারা দ্রুত উপলব্ধি করল যে, তারা নেতৃত্বের অমার্জনীয় অবহেলায় পথভ্রষ্ট হয়েছে। এরপর থেকেই শ্রমিক-ছাত্র বিক্ষোভের মাধ্যমে মিসরীয়রা নিরাপত্তা বাহিনীর সংস্কারের দাবি তুলেছিল। যুদ্ধে পরাভূত সামরিক কর্মকর্তারাই বিক্ষোভকারীদের লঘু হলেও শাস্তি দান করতে থাকলে উত্তেজিত বিক্ষোভকারীরা মিলিটারির একটি বিশেষ সুবিধাভোগী শ্রেণীর নিরঙ্কুশ ক্ষমতা এবং গোয়েন্দা সংস্থার নিয়ন্ত্রিত রাষ্ট্রের পরিসমাপ্তির দাবিতে সোচ্চার হয়েছিল। বিকল্প হিসেবে তারা তুলে ধরেছিল দীর্ঘস্থায়ী সংগ্রামের জন্য একটি বিপ্লবী সংগঠনের উদ্ভাবন।
কিন্তু মিসরে সামরিক পরাজয়ের বিপর্যয়ের পর মন্ত্রিসভায় সামরিক বাহিনীর সদস্যদের অনুপাত শতকরা ৬৬ ভাগ থেকে ২২ ভাগে নেমে যায়। ১৯৭৫ সাল নাগাদ তা আরো হ্রাস পেয়ে ১৫ ভাগে নেমে আসে। সত্তরের দশকে মিসরীয় অভ্যন্তরীণ ও বৈদেশিক নীতিতে অনেক পরিবর্তন হওয়ায় সামরিকই স্টাব্লিশমেন্ট রাজনৈতিক নেতৃত্বের সিদ্ধান্তই শিরোধার্য করে। ১৯৮৬ সালে সামরিক বাহিনী আধাসামরিক নিরাপত্তা বাহিনীর বিদ্রোহ দমনেও হস্তক্ষেপ করেছিল। আশির দশকের শেষ ভাগে ও নব্বইয়ের দশকের শুরুতে মিসরীয় সরকারের জন্য হুমকির উৎস সামরিক বাহিনী ছিল না, বরং তার স্থান নিয়েছিল ইসলামি জঙ্গি গোষ্ঠী। এই জঙ্গিরা আর্মির নিম্ন ও মধ্যস্তরে অনুপ্রবেশের প্রাণান্তকর চেষ্টা করেছিল।
ইসলামি লিবারেশন পার্টি নামক এক জঙ্গি গোষ্ঠী প্রেসিডেন্ট আনোয়ার সাদাতকে উৎখাত করার চেষ্টা করেছিল। অন্য একটি জঙ্গি সংগঠন জিহাদ আল জুমার নামে গোয়েন্দা সংস্থার কর্নেলের নেতৃত্বে সাদাতকে হত্যা করতে সক্ষম হয়। এই পর্যায়ে যদি আর্মি ক্ষমতা গ্রহণ করে, তারা দেশকে খুব একটা কিছু দিতে পারবে না বলে তারা জানে। তাদের কাছে মিসরের পুঞ্জীভূত ঋণ পরিশোধের কোনো উপায় জানা নেই। জানা নেই সামাজিক অস্থিরতা এবং গোষ্ঠীগত বিভেদ ও তজ্জনিত উত্তেজনার কোনো সমাধান। আর্মি জানে যে, দেশের বিশাল বেকারত্ব দূরীকরণে তাদের কাছে কোনো জাদু নেই। সর্বোপরি মিসরের দীর্ঘ দিনের মিত্র যুক্তরাষ্ট্রের সাথে সম্পর্ককে স্থিতিশীল রাখারও কোনো মন্ত্র নেই আর্মির কাছে।
২০১০ সালের শুরুতে হোসনি মোবারক জোর দিয়েই বলেছিলেন, তিনি বিশ্বাস করেন না যে আর্মি প্রেসিডেন্সির জন্য কোনো বেসামরিক প্রার্থীর বিরোধিতা করবে। কিন্তু যে বেসামরিক প্রার্থীর কথা তার মনে ছিল তিনি হলেন তারই পুত্র গামাল মুবারক, বিরোধীদলীয় নেতা এল বারাদি নন। তবে আর্মির বিরোধিতা না করা সংক্রান্ত তার ধারণা সত্যই ছিল। আর্মি বর্তমানের প্রেক্ষাপটে আর প্রেসিডেন্সিতে আগ্রহী নয়। কিন্তু কিছু বিষয়ে আর্মি এখনো আগ্রহী।
প্রথমত, আর্মির জন্য ভর্তুকি ব্যবস্থার প্রলম্বন, যা ক্রমবর্ধমান মুদ্রাস্ফীতি থেকে আর্মিকে সুরক্ষা দেবে। মার্কিন অর্থায়নে সৃষ্ট এক প্রচণ্ড অর্থলিপ্সা শুধু মোবারক বা তার অনুগত জেনারেলদেরকেই নয়, সমগ্র আর্মিকে সংক্রমিত করে রেখেছে। আর্মির কর্মকর্তা শ্রেণী মিসর-মার্কিন মৈত্রীর দিনগুলোতে দেখেছে যে, কায়রোর আমেরিকান বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন গ্র্যাজুয়েট সিটি ব্যাংক জাতীয় কোনো করপোরেশনে চাকরি করে একজন জেনারেলের চেয়ে চার গুণ অধিক রোজগার করতে পারেন।
তবে তাদের অন্তরে লালিত একপ্রকার ভোগবাদের পূর্বশর্ত হলোÑ দেশে স্থিতিশীলতা। যে মহলই সেই স্থিতিশীলতার বিধান করতে সক্ষম, রাষ্ট্রক্ষমতা তাদের হাতে চলে যাওয়ায় মিসরীয় সামরিক বাহিনীর কোনো ক্ষোভ বা দুঃখ নেই। 
লেখক : অবসরপ্রাপ্ত ব্রিগেডিয়ার এবং নিরাপত্তা, রাজনীতি, বৈদেশিক নীতি ও আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিশ্লেষক

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন