বৃহস্পতিবার, ৩১ মে, ২০১২

মৃত্যুপুরীতে বসবাস

এম আবদুল হাফিজ
এ দেশের মানুষের কাছে অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনালের সদ্য প্রকাশিত বার্ষিক প্রতিবেদনটি কোন অভিনব বার্তা বহন করে না। তারা হাড়ে হাড়ে বোঝে ও জানে বিচারবহির্ভূত হত্যা-ম”ছবের তথ্য এবং নীরবে অন্তরে বহন করে এসব হত্যার দুঃসহ স্মৃতি ও কষ্ট। এর আগেও দেশী-বিদেশী মানবাধিকার সং¯’াগুলো একই প্রকার তথ্য বাংলাদেশ সম্বন্ধে তুলে ধরেছে, যার প্রতি সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের প্রতিক্রিয়ায়ও এ দেশে মানবাধিকার পরি¯ি’তির ভয়াবহতা কোন গুর“ত্ব পায়নি। এমন প্রতিবেদন বারবার প্রকাশিত হওয়ার পরও ক্রসফায়ার, পুলিশ হেফাজত বা রিমান্ডে নির্যাতনজনিত মৃত্যু হ্রাস পাওয়া তো দূরের কথা, এসবের মাত্রা বরং বেড়েই চলেছে। বেড়ে চলেছে রাজনৈতিক প্রতিহিংসা, সামাজিক অ¯ি’রতা এবং আইন-শৃংখলা বাহিনী বিশেষ করে এলিট ফোর্স র‌্যাবের বাড়াবাড়ি। প্রকারান্তরে দেশ পরিণত হয়েছে পুলিশ নিয়ন্ত্রিত রাষ্ট্রে, যেখানে যুক্তির ভাষা বল প্রয়োগে স্তব্ধ হয়েছে। একটি ক্ষমতা মদমত্ত সরকার যেন যুদ্ধ ঘোষণা করেছে তারই কাছে নিরাপত্তা প্রার্থী জনগণের বির“দ্ধে।
তাই চারদিকে এত মৃত্যুর ছড়াছড়ি। এই মৃত্যুর অনেক সংবাদ অজ্ঞাত থেকে গেলেও মিডিয়ার মাধ্যমে আমরা যেটুকু অবহিত হই, সেটাই যথেষ্ট একথা প্রমাণ করতে যে, আমরা যেন এক সাক্ষাৎ মৃত্যুপুরীর মধ্যেই অব¯’ান করছি। সংবাদপত্রে আমরা যেসব বেওয়ারিশ লাশ, খণ্ডিত মৃতদেহ, গলিত-অর্ধগলিত লাশের পথেঘাটে, খানাখন্দে, ডোবা-জলাশয়ে পড়ে থাকার খবর পড়ি, তারা কারা? তাদের কি কোন স্বাভাবিক মৃত্যু হয়েছে? এসব মৃতের মৃত্যুর দায়ভার কার? একটি দেশ সম্বন্ধে যে কারও কী ধারণা জš§াতে পারে, যেখানে বাজারের ব্যাগে খণ্ডিত মস্তক পাওয়া যায়?
এসব অস্বাভাবিক মৃত্যুর কি কোন সঙ্গত ব্যাখ্যা আছে? রাষ্ট্র কি তার নাগরিকদের জন্য তার ওপর অর্পিত দায়িত্ব পালন করেছে? ক্ষমতাসীনরা অবশ্যই বিচারবহির্ভূত মৃত্যুর পক্ষে নয়। কিš‘ তা যাতে না ঘটতে পারে তার ব্যব¯’া গ্রহণ কি তারা নিশ্চিত করেছে? এসব প্রশ্নবাণে জর্জরিত কর্তৃপক্ষ যতই তারস্বরে তার নির্দোষ থাকার কথা বলুক, তা কি বিশ্বাস বা গ্রহণযোগ্য?
যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্র দফতরের প্রতিবেদনে বাংলাদেশের গুম, পুলিশ হেফাজতে মৃত্যু, অকারণে নিয়মবহির্ভূতভাবে সাদা পোশাকধারী ডিবি পুলিশের গ্রেফতার এবং বিচারপূর্ব দীর্ঘ কারাবাসকেও মানবাধিকার লংঘন বলা হয়েছে। এসবের পাশাপাশি তো আরও রয়েছে সর্বজনবিদিত বিচার বিভাগের রাজনীতিকরণ, বাক-স্বাধীনতার সীমাবদ্ধতা ও সাংবাদিক নির্যাতন এবং সর্বগ্রাসী রাজনৈতিক সহিংসতায় মৃত্যু। এ বাস্তবতার মধ্যেই বাঁচতে হয় এ দেশে।
ইলিয়াস আলীর নিখোঁজ ও সাগর-র“নীর মৃত্যু রহস্য উদঘাটনে সরকারের দুর্বোধ্য ঔদাসীন্য ও ব্যর্থতা নিয়েও প্রশ্ন তুলেছে যুক্তরাজ্যভিত্তিক অ্যামনেস্টি। সং¯’াটির মতে, রাজনৈতিক সদি”ছার অভাব ও আইন-শৃংখলা বাহিনীর ক্ষমতার অপব্যবহারে বাংলাদেশে মানবাধিকারের দৃশ্যমান কোন উন্নতি নেই। ক্ষমতাসীনরা তাদের ক্ষমতার শেষ বেলায় স্বভাবতই তাদের আখের গোছাতেই ব্যস্ত। এটাই স্বাভাবিক। বিএনপি নেতৃত্বাধীন চারদলীয় জোটও তাই করেছিল তাদের মেয়াদের অন্তিম সময়ে। মাঝে মাঝে ভাবি, এমনই কদর্য বাস্তবতার মধ্য দিয়েই আমরা ফুরিয়ে যাব। দেশ ও তার ভবিষ্যৎ নিয়ে যতই আশাবাদ পোষণ করি, যতই আশায় বুক বাঁধি এবং উš§ুখ অপেক্ষায় থাকি একটি ইতিবাচক পরিবর্তন দেখব বলেÑ পরক্ষণেই তা ধসে পড়ে হত্যা, গুম, নির্যাতনে এক গুলাগ বা গুয়ানতানামো সদৃশ এ দেশের ভাবমূর্তি গড়ে ওঠা দর্শনে। খোদ যুক্তরাষ্ট্রের নৃশংসতা নিয়ে কথা বলা যায়, প্রতিবাদ করা যায়। কিš‘ বাংলাদেশের আইন-শৃংখলা বাহিনীর বির“দ্ধে নেতিবাচক বক্তব্য মারাÍক ঝুঁকিপূর্ণ। সে যেন শ্বাপদসংকুল অরণ্যে বাস করে ব্যাঘ্রের লেজে হাত দেয়া। যদিও অনেক অপরাধের সঙ্গেই নাকি তাদের কমপ্লিসিটি একটি ওপেন সিক্রেট। ইদানীং সংবাদপত্রে দেখেছি, তারা নাকি আওয়ামী ক্যাডারদের সঙ্গে মিলেমিশে চাঁদাবাজি করে।
কিš‘ তারা তো এ দেশের বাস্তবতায় সবকিছুই করতে পারে। কেননা, খোদ সরকার টিকে থাকার জন্য এবং সরকারের প্রতিপক্ষকে ঠেঙানোর জন্য তাদের ওপরই নির্ভরশীল। সুতরাং তাদের মধ্যে পারস্পরিক একটা আপস-সমঝোতা থাকাই স্বাভাবিক। কিš‘ কতদিন তারা একটি আন্তর্জাতিক বিরূপ প্রতিক্রিয়া উপেক্ষা করে চলতে পারবেÑ সেটাই আশার কথা, যদিও সে আশা অত্যন্ত ক্ষীণ। কেননা, এখন তো দেশে প্রতিবাদের সুযোগও আর থাকছে না। বিরোধী দলও তার অতীতের সব গ্লানি সর্বাঙ্গে জড়িয়ে নিত্য নতুন মামলায় জর্জরিত। তারা শাসর“দ্ধকর বর্তমান রাজনৈতিক আবহে কতটা সুবাতাসের সঞ্চার করতে পারবে, তা নিয়ে প্রশ্ন দেখা দিয়েছে।
আমরা জানি না, বাংলাদেশের এই মৃত্যুপুরীতে অহরহ লাশের গন্ধের বিকৃত এক বাস্তবতায় কতকাল প্রলম্বিত হবে এ দেশবাসীর বসবাস। শেষ পর্যন্ত কি সব আশা নিভে গেলে আমরা একটি নিñিদ্র অন্ধকারে দীর্ঘ পথের এক কানাগলিতে আটকে যাব, যেখান থেকে নিষ্ক্রমণের কোন পথ নেই? কিš‘ আমরা বিশ্বাস করি যে আমাদের ত্রাণকর্তা একজন আছেন, যিনি শক্তি মদমত্তদের সব কৌশলের জালকে মাকড়সার জালের মতো ছিন্নভিন্ন করে দিতে পারেন। যিনি তার এক প্রেরিত পুর“ষকে মাছের পেটের অন্ধকার থেকে মুক্তি দিয়েছিলেন। সর্বোপরি অনুকূল ও প্রতিকূল অব¯’ার স্রষ্টাও তিনি।
মানুষের ভাগ্যের চালিকাশক্তিও একই উৎসের সৃষ্টি। আমি আইয়ুব-ইয়াহিয়ার প্রায় একই প্রকার শক্তি মদমত্ততা দেখেছি। বিশ্বের বিভিন্ন সময়কার বিভিন্ন স্বে”ছাচারীর একই প্রকার ক্ষমতার খেলা ও বিয়োগান্ত ভাগ্য বরণের ইতিকথা সমসাময়িক ইতিহাসে পড়েছি। আমাদের স্বৈরশাসকদেরও ভাগ্য যে অভিন্নই হবে সে সম্বন্ধে আমি নিশ্চিত। ইতিমধ্যে মানুষের মঙ্গল কামনায় বা অন্যায়ের প্রতিরোধে বা সত্য ভাষণের জন্য যারা শাসকগোষ্ঠীর কোপানলে পড়ে নিখোঁজ, অপহƒত বা অস্বাভাবিক ও অজ্ঞাত মৃত্যুর শিকার হয়েছেন, লাখো মানুষের মানসপটে অংকিত তাদের সমাধিতে আমাদের ‘এপিটাফ’ : আমরা তোমাদের ভালোবেসেছিলাম।
এম আবদুল হাফিজ : নিরাপত্তা বিশ্লেষক

শনিবার, ২৬ মে, ২০১২

রেটোরিক কেউ পছন্দ করে না


এম আবদুল হাফিজ
রাজনীতিতে রেটোরিক বা বাগাড়ম্বর ক্ষমতাসীনদেরই বিশেষ অধিকার। তারা পদাধিকারবলে আরও অনেক সুবিধা ভোগ করেন, যাতে বিরোধীদলীয়দের অংশীদারিত্ব নেই। ক্ষমতাসীনদের আচরণ-উচ্চারণ নিয়ে কদাচিৎ কেউ কোনো প্রশ্ন তোলে। রাজনীতির দ্বন্দ্বে ঐতিহ্যগতভাবেই বিরোধী দল দুর্বল পক্ষ এবং সেভাবেই তা তাদের চেতনায় রেখে রাজনীতি পরিচালিত হয়। বিগত নির্বাচনে পরাজয়ের প্রচণ্ড ধাক্কা সামলে ওঠার অব্যবহিত পরই রাজনীতির অঙ্গনে দলটি সরব হয়ে ওঠে এবং মূল মঞ্চে তার উত্তরণ ঘটে। সংসদে মাত্র ক'জন সদস্য নিয়ে কী করতে পারবে তার হিসাব-নিকাশ করেই বিএনপি রাজপথেই অধিক সক্রিয় হতে চেষ্টা করে।
একথা স্বীকার করতেই হবে যে, বিগত সাড়ে তিন বছরের আওয়ামী শাসনামলে অন্তত রাজপথে বিএনপি নেতৃত্বাধীন জোট তাদের ভিত পাকা করে ফেলেছে। জোটনেত্রী খালেদা জিয়ার জনপ্রিয়তা তো ২০০৮ সালের নির্বাচনে আওয়ামী সমর্থক ঝড়েও অক্ষত ছিল। সংসদে না হলেও দেশের জনগোষ্ঠীর মধ্যে দলটি সমর্থনের সমতা রক্ষা করতে পেরেছিল। এ সত্ত্বেও বিএনপির বিগত মেয়াদের রেকর্ড ভালো ছিল না। তবু শুধু আওয়ামীদের অকল্পনীয় দুঃশাসনের কারণে বিএনপি তার হাতছাড়া রাজনৈতিক পরিসরের অনেকটাই পুনর্দখলে সমর্থ হয়।
বিএনপি তার সত্বর পুনরুত্থানে দুঃসাহসিক হয়ে কিছু ভুল পদক্ষেপে প্রবৃত্ত হয়। দলটি কিছু বাগাড়ম্বর ও আলটিমেটামের রাজনীতিতে জড়িয়ে পড়ে, যা রাজনীতিতে এমনকি ক্ষমতাসীনদের জন্যও ভালো নয়। ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ তথা মহাজোটকে তা মানালেও এবং তারা সে ঝুঁকি নেওয়ার ক্ষমতা রাখলেও বিরোধী দলের জন্য এ পর্যায়ে তা মোটেই যৌক্তিক নয়। স্মরণ করা যেতে পারে, আওয়ামী লীগ একইভাবে বিএনপির শাসনামলে সরকার পতনের আলটিমেটাম দিয়েছিল এবং নির্বুদ্ধিতা ও শূন্যগর্ভ আস্ফালনের জন্য আওয়ামী সেক্রেটারি জেনারেল আবদুল জলিল হাস্যাস্পদ হয়েছিলেন।
রাজনীতিকদের মধ্যে বড় বড় বুলি আওড়ানোর প্রবণতা থাকে। তাছাড়া নিজেদের বড়ত্ব এবং শক্তি জাহির করার একটি প্রচ্ছন্ন ঝোঁক প্রায় সময়ই অনভিপ্রেত পরিণতিতে পেঁৗছায়। বিএনপির সামান্য ক'জন নেতা যারা এখনও কারামুক্ত তাদের প্ররোচণামূলক ভাষণ ও আচরণ সরকারকে ক্ষেপিয়ে তুলছে এবং দলকে অনিশ্চিত অবস্থার মুখোমুখি করছে।
১০ জুনের আলটিমেটামসহ বিএনপির অযাচিত হুংকার_ প্রয়োজনে তারা একদফার আন্দোলন তথা সরকার পতনের আন্দোলনের সূচনা করবে। অথচ বিএনপি জানে, নির্বাচিত একটি সরকারের পতন হয় না। যেমন দুর্ধর্ষ আন্দোলনকারী আওয়ামী লীগও তাদের একই প্রকার হুংকার সত্ত্বেও বিগত মেয়াদের বিএনপি নেতৃত্বাধীন জোট সরকারকে উৎখাত করতে সমর্থ হয়নি। নির্বাচিত কোনো সরকারের মেয়াদ পূর্তির আগে পতন হওয়া উচিতও নয়। তেমনটি হলে সত্যিকার অর্থেই রাষ্ট্র নৈরাজ্যে নিপতিত হয়। তাই সব দলেরই রাজনীতিতে সংযম ও ধৈর্যের প্রয়োজন। ক্ষমতাসীন সরকার নির্বাচনের প্রাক্কালে এমনই বাড়াবাড়ি করে থাকে_ হার্ডলাইনে যায়, যদিও আখেরে কোনো লাভ হয় না। জনগণ একবার বিরূপ হলে তার প্রকাশ চলমান ঘটনাপ্রবাহে কোনো না কোনোভাবে প্রতিফলিত হয়।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় সিন্ডিকেট নির্বাচনে আওয়ামীদের ওয়াশ আউটে জনরোষ এবং বিরাগের ক্ষুদ্র স্ফুলিঙ্গ পরিলক্ষিত হলো। এর জন্য কোনো আলটিমেটামের দরকার হয়নি। তবে সরকারের যে কোনো দুরভিসন্ধি বাস্তবায়নের পথে অহিংস কার্যক্রম নেওয়া যেতে পারে। সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ তা হলো, সরকারের মহামারীসদৃশ দুর্নীতি ও অনিয়ম সম্পর্কে জনগণকে সচেতন রাখা। হুমকি-ধমকি, শাসানো রাজনীতির কোনো গ্রহণযোগ্য নীতি নয়। এমনিতেই এমনকি অর্থমন্ত্রী স্বীকৃত সর্বব্যাপী দুর্নীতির প্রসার যে দুর্গন্ধ ছড়িয়েছে সুরঞ্জিত বাবুদের বদৌলতে তা এখন সর্বজনবিদিত। দুর্নীতির একটি কুকীর্তি ঢাকতে গেলে আরেকটি বেরিয়ে পড়ছে। সংবাদপত্রে প্রতিবেদন অনুযায়ী এখন নাকি আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর লোকজন আওয়ামী ক্যাডারদের সঙ্গে মিলেমিশে প্রকাশ্যে চাঁদাবাজি করে। ভোগবাদে আসক্ত আওয়ামী পরিবারের অন্তর্ভুক্ত নব্য ধনীদের চাহিদার অন্ত নেই। যাদের একটি ফ্ল্যাট আছে তারা আরও চায়, যাতে পরিবারের প্রতিটি সদস্য স্বতন্ত্রভাবে থাকতে পারে।
অবস্থাদৃষ্টে মনে হয়, আওয়ামী ফন্দি ও চাতুর্য তাদের গলার ফাঁস হবে এবং বিএনপি তার স্বাভাবিক উত্থানের ধারা ধরে রাখতে পারবে। কিন্তু তাদের রেটোরিক লোকে পছন্দ করবে না, বিশেষ করে সরকার পতনের হুংকার। জনগণ একটি ক্ষমতাসীন দলকে একটি নির্দিষ্ট সময়ের জন্য ম্যান্ডেট দেয়। সে সময় উপনীত হওয়ার আগে তাদের টেনে নামানোর চেষ্টা জনগণের রায়ের প্রতি অশ্রদ্ধা প্রদর্শনেরই শামিল।

ব্রিগেডিয়ার (অব.) এম আবদুল হাফিজ : সাবেক মহাপরিচালক বিআইআইএসএস ও কলাম লেখক

বৃহস্পতিবার, ২৪ মে, ২০১২

স্নায়ুচাপে ইরান

স্নায়ুচাপে ইরান



॥ এম. আবদুল হাফিজ ॥

পাশ্চাত্যের গণমাধ্যমে প্রায়ই ইরানে আসন্ন আক্রমণের সংবাদ বেরোয়। ওবামা প্রশাসনও ‘টেবিলে সব অপশন থাকার’ পুনরাবৃত্তি করে থাকে। যুক্তরাষ্ট্রের সামরিক বাহিনী এক যুগেরও বেশি ধরে জল-স্থল-অন্তরীক্ষে যুদ্ধ প্রস্তুতিতে পারস্য উপসাগরে ল্যান্ডিংড্রিলের প্রশিক্ষণ গ্রহণরত। সম্প্রতি পেন্টাগন ওই অঞ্চলে মার্কিনিদের রণপোতের সংখ্যা দ্বিগুণ করেছে। কিছু দিন হলো, ইরানের আকাশে মার্কিন যুদ্ধ ও গোয়েন্দা বিমানের ওড়াউড়িও শুরু হয়েছে। গত বছরের শেষ দিকে ইরানিরা যুক্তরাষ্ট্রের একটি অত্যাধুনিক চালকবিহীন বিমান ভূপাতিতও করেছে।
ইসরাইলি গণমাধ্যমেও গুজবের অন্ত নেই। এমন একটি গুজব হলো, হরমুজ প্রণালীতে জেগে ওঠা ছোট দু’টি দ্বীপে মার্কিনিদের অবস্থান গ্রহণ সম্পর্কিত। তিন বছর আগে গাজা হত্যাকাণ্ডের হোতা বলে পরিচিত ইসরাইলি প্রতিরক্ষামন্ত্রী গত ফেব্রুয়ারিতেই বলেছিলেন, ইরান আক্রমণের সুযোগ ক্রমেই মিলিয়ে যাচ্ছে, কেননা ইরানের অব্যাহত ইউরেনিয়াম সমৃদ্ধকরণ সেটি হতে দেবে না। ইসরাইলি উপপ্রধানমন্ত্রী মোসে ইয়ালন ঘোষণা দেন, তার দেশ যথেষ্টই আত্মবিশ্বাসী যে, তারা ইরানের বাছাই করা যেকোনো লক্ষ্যবস্তুতে আঘাত হানতে সক্ষম। তিনি আরো বলেন, ইসরাইলি সামরিক বাহিনীর প্রধান হিসেবে তার লব্ধ অভিজ্ঞতা থেকেই তিনি এমন প্রত্যয় ব্যক্ত করছেন। 
সদ্য বিদায়ী ফরাসি প্রেসিডেন্ট নিকোলাস সারকোজি বলেন, তার যুদ্ধে উসকানি অযৌক্তিক হবে যদি ইরান বোমা অর্জনে এবং পড়শিদের ভীতি প্রদর্শন করতে উন্মাদের মতো আর না ছোটে। সারকোজি হয়তো কখনো ভাবেননি, আধুনিক কালে ইরান কখনো কারো বিরুদ্ধে যুদ্ধ শুরু করেনি। পাশ্চাত্য ও আরব রাজতন্ত্ররাই সাদ্দাম হোসেনকে ইরান আক্রমণ করতে উৎসাহ দিয়েছিল। আট বছর দীর্ঘ সেই যুদ্ধে ১০ লাখ ইরানি আত্মাহুতি দিয়েছিলেন।
পাশ্চাত্যের এসব ভয়ভীতিকে উপেক্ষা করেছে তেহরান। ইরানের ৩৩তম বিপ্লববার্ষিকী উদযাপন উপলক্ষে প্রেসিডেন্ট মাহমুদ আহমাদিনেজাদ বলেছেন, ইসলামি প্রজাতন্ত্র শিগগিরই পারমাণবিক ক্ষেত্রে কিছু গুরুত্বপূর্ণ অর্জনের খবর দেবে। শীর্ষ নেতা আয়াতুল্লাহ আলী খামেনি ইরান তার শান্তিপূর্ণ পারমাণবিক কর্মসূচির অধিকার কিছুতেই বর্জন না করার সঙ্কল্প পুনর্ব্যক্ত করেছেন। ইরান একই নীতিতে অবিচল থেকে বারবার নিজেকে এনপিটিতে স্বাক্ষরকারী দেশরূপে স্বীকার করে আসছে এবং সেই অবস্থানে থেকেই তার একটি শান্তিপূর্ণ কর্মসূচি পরিচালনার অধিকারের কথাই বলে আসছে।
ইরানের সব পারমাণবিক স্থাপনা এবং সেখানে কর্মরত সব কিছুই আইএইএর নজরে আছে। ইরান যে কোনো পারমাণবিক অস্ত্র তৈরি বা ইউরেনিয়াম তৈরি করেনি তা নিশ্চিত করার জন্য ওই সংস্থাটিই যথেষ্ট। আয়াতুল্লাহ খামেনি পাশ্চাত্যকে কোনো সামরিক অ্যাডভেঞ্চারের বিরুদ্ধে কড়া সতর্ক করে দিয়েছেন এই বলে, যদি কোনো বিরুদ্ধাচরণের সূত্রপাত হয়, সেটি কিন্তু আমেরিকানদের জন্য অন্তত ১০ গুণ ভয়ঙ্কর হবে।
ইসরাইলের হুমকির বিরুদ্ধে প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করতে গিয়ে খামেনি বলেন, দেশটি প্রকৃতপক্ষে একটি ক্যান্সার বা টিউমার সমগ্র অঞ্চলের জন্য, যা কেটে ফেলা ছাড়া সমস্যার সুরাহা হবে না।
মার্কিন প্রতিরক্ষামন্ত্রী লিও প্যানেটা গত ফেব্রুয়ারিতে ব্রাসেলসে গণমাধ্যমকে বলেছেন, এ বছরের মাঝামাঝি কোনো এক সময় ইসরাইল ইরান আক্রমণ করবে। গত ২০ ডিসেম্বর জয়েন্ট চিফ অব স্টাফের চেয়ারম্যান জেনারেল মার্কিন ডেমসসে সিএনএনকে বলেন, ইরানের বিরুদ্ধে প্রয়োগের জন্য সব রকম অপশনই পরীক্ষা করে দেখা হচ্ছে। আমরা সেগুলো পরিমার্জন ও পরিশোধন করে দেখছি। ওই অপশনে পৌঁছলে কার্য সিদ্ধি হবে। ‘আমি সন্তুষ্ট আমাদের পরীক্ষণীয় অপশনগুলো এমন এক বিন্দুতে পৌঁছাচ্ছে, যেখানে মনে হয় তা কাজ করবে।’ ইসরাইলের দক্ষিণপন্থী সরকার সর্বক্ষণ ইরানের সাথে যুদ্ধ বাধানোর ফন্দিফিকিরে আছে। এই উগ্র সরকারটি ঠাণ্ডা মাথায় প্রায় স্থির করেই ফেলেছে এবং ধরেই নিয়েছে, বছর শেষে নির্বাচনে জড়িয়ে পড়ার আগে ওবামা প্রশাসনের সামনে ইসরাইলসহ ইরান যুদ্ধের পাট চুকিয়ে ফেলা ছাড়া আর কোনো পথ খোলা নেই।
কিন্তু ওবামা প্রশাসনের বাস্তববাদীরা জানেন ইরানের বিষয়টি ইরাকের মতো নয়, বরং অনেক আলাদা। মার্কিনিরা ইরাককে কয়েক সপ্তাহের মধ্যে কাবু করতে ও দখল করতে পেরেছিল। প্রেসিডেন্ট ওবামা ফেব্রুয়ারিতে যুদ্ধের মেজাজকে একটু নমনীয় করতে বলেছিলেন, ইসরাইল তো এখন পর্যন্ত তাদের যুদ্ধের পরিকল্পনাই তৈরি করেনি। তিনি জোর দিয়ে বলেনÑ আমেরিকা ও ইসরাইল যূথবদ্ধভাবেই ইরান সমস্যা সমাধানে কূটনীতির পথে এগিয়ে আসবে। ইত্যবসরে মার্কিন প্রেসিডেন্সির জন্য রিপাবলিকান প্রার্থীরা অবশ্য 'bomb, bomb Iran' -এর ধুয়া তুলেছেন।
এ দিকে পারমাণবিক ইস্যুতে ইরানিরা এত বেশি একতাবদ্ধ, যা আগে কখনো ছিল না। আরব রাজতন্ত্রগুলো পাশ্চাত্যের মনস্তাত্ত্বিক ও অর্থনৈতিক লড়াইকে নিঃসন্দেহে সমর্থন দিয়ে যাচ্ছে। তারা জানে স্নায়ুর এই লড়াইয়ে ইরানেরও রয়েছে অনেক কার্ড। আরব দেশগুলোর শিয়া সম্প্রদায়ও ইতোমধ্যে তাদের একাধিক দাবিতে সোচ্চার। তারাও তাদের গণতান্ত্রিক অধিকার প্রতিষ্ঠা করতে চায়। ইরানের ওপর কোনো যুদ্ধ চাপিয়ে দেয়ার ক্ষেত্রে ইরান উপসাগরীয় আরব দেশগুলোতে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা মার্কিন ঘাঁটিগুলোকে টার্গেট করবে বলে হুঁশিয়ারি উচ্চারণ করেছেন উচ্চপদস্থ ইরানি কর্মকর্তারা। 
ইরান একটি যুদ্ধসাপেক্ষে যদি হরমুজ প্রণালী বন্ধ হয়ে যায় এবং তেলের ট্যাংকারগুলো আটকা পড়ে, তাহলে তেলের মূল্য আকাশচুম্বী হবে; যা একটি নির্বাচনী বছরে আমেরিকানদের জন্য সুখকর হবে না। সাথে সাথে একটি সমান্তরাল পথে যুক্তরাষ্ট্র বেপরোয়াভাবে তার ট্রাডিশনাল মিত্র এবং বাণিজ্যিক সহযোগীদের বেকায়দায় ফেলেছে, যার আওতায় ইরান বা ভারতের মতো দেশও রয়েছে। ফলে যুক্তরাষ্ট্র নিজের একপক্ষীয় অবরোধকে কার্যকর করতে তার সাথে কোনো প্রকার বিবাদবিহীন দেশেরও ক্ষতির কারণ ঘটিয়েছে।
আলোচনার জন্য সম্প্রতি যখন ভারতের পররাষ্ট্র সচিব রঞ্জন মাথাই ওয়াশিংটনে যান। স্টেট ডিপার্টমেন্টের মুখপাত্র ভিক্টোরিয়া ল্যান্ড রিপোর্টার্সদের বলেন, ভারত কী করে জ্বালানির একটি বিকল্প উৎস পেতে পারে, সেটিই আলোচ্য। তিনি বলেন, যুক্তরাষ্ট্র এক ধরনের Two Track Policy বাস্তবায়ন করতে যাচ্ছে, যাতে ইরানি তেলে অভ্যস্তদের ওই অভ্যাস থেকে ছাড়িয়ে নেয়া এবং বিশ্বজুড়ে সাপ্লাইয়ারকে গ্রাহকদের সাথে যুক্ত করে দেয়া যায়। তারাই তখন গ্রাহকদের বিকল্প উৎসের সন্ধান দেবে।
এরই মধ্যে সৌদি সরকার অঙ্গীকার করেছে, তারা তাদের জ্বালানির উৎপাদন বৃদ্ধি করেছে, যাতে অবরোধের ফলে আন্তর্জাতিক বাজারে ইরানি তেলের ঘাটতি মেটানো যায়। ওবামা প্রশাসন সম্প্রতি মার্কিন ব্যাংকগুলোকে ওই সব ব্যাংকে গচ্ছিত ইরানি সম্পদ জব্দ করার ক্ষমতা দিয়েছে, যাতে ইরান আর ওই সম্পদকে তার সুবিধামতো অন্যত্র স্থানান্তর করতে না পারে। ইরানের ভাইস প্রেসিডেন্ট মোহাম্মদ রেজা রহিমি সাম্প্রতিক অবরোধে ক্রুদ্ধ প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করে বলেছেন, ইরান অবশ্যই এ অবরোধকে অকার্যকর করবে। অতীতেও ইরান তা করেছে এবং জ্বালানি পিপাসার্তদের কাছে ইরান জ্বালানি বিক্রয়ে সক্ষম হয়েছে।
তবে অবরোধ দেরিতে হলেও তার প্রভাব ফেলছে ইরানের জনজীবনে। মুদ্রাস্ফীতি আর ওষুধের মতো প্রয়োজনীয় বস্তুর মহার্ঘতায় জনজীবন বিপর্যস্ত। ভারত ইরানের তেল-গ্যাস ক্রেতাদের মধ্যে অন্যতম বৃহৎ দেশ। দেশটির শীর্ষ নীতিনির্ধারক বলেন, ইরানি তেলের ওপর তাদের নির্ভরতা ক্রমেই কমছে, তবু ভারতের জন্য ইরানই তাদের জ্বালানির প্রধান উৎস। ভারত অপরিশোধিত তেলের ১২ শতাংশ ইরান থেকে সংগ্রহ করে। ভারত সরকারের সাম্প্রতিক ঘোষণা যে, দেশটি ‘ইরানের সাথে অর্থনৈতিক সম্পর্ক দৃঢ় করতে সেখানে একটি বড় ডেলিগেশন পাঠাচ্ছে,’ তা ওয়াশিংটনকে নারাজ করেছে। ভারতের বাণিজ্যসচিব রাহুল খুলুর গণমাধ্যমকে বলেছেন, ভারত জাতিসঙ্ঘ আরোপিত অবরোধ বাস্তবায়ন করছে, কিন্তু ইরানে আমাদের প্রেরিতব্য অনেক আইটেমে অবরোধ প্রযোজ্য নয়।
ইরান আইটেম রুপিতে পরিশোধ্য এবং দেশটিতে বিনিময় প্রথায় বাণিজ্য করা যায়। ভারতীয় কর্মকর্তাদের মতে, পাশ্চাত্যের কাছ থেকে এমন চাপ আসার কথা নয় যা ভারতীয় অর্থনীতিকে ক্ষতিগ্রস্ত করবে। এমনকি ইরানের সাথে অবরোধের ফাঁকফোকর দিয়ে পাকিস্তানও বাণিজ্যে আগ্রহী। পাশ্চাত্যের সতর্কীকরণ উপেক্ষা করেই পাকিস্তান ঘোষণা দিয়েছে, ইরানের সাথে দেশটির গ্যাস পাইপলাইনের কাজ অব্যাহত থাকবে। ওয়াশিংটন বরং ভারতের সাথে গ্যাস পাইপলাইন ইস্যুতে অধিক সফল। প্রেসিডেন্ট বুশের ধমকে ভারত অনেক আগেই আইপিআই থেকে সরে এসেছিল। মুখ রক্ষায় ভারত ওজর দিয়েছিল অর্থনৈতিকভাবে প্রকল্প পাকিস্তানকেই বেশি ফায়দা দেবে, ভারতকে নয়।
মার্কিন চাপে আরো অনেক বেসরকারি কোম্পানি ইরানের পরিশোধিত তেল ক্রয়ের চুক্তি বাতিল করেছিল। ওবামা প্রশাসন স্বভাবতই ইরানের সাথে অর্থনৈতিক সম্পর্ক বিস্তৃত করার ভারতীয় সিদ্ধান্তে অসন্তুষ্ট। তবে সিনিয়র ভারতীয় কর্মকর্তারা ইরানের সাথে সম্পর্ক রাখার বিষয়ে বেশ জেদি। তারা এমনও উল্লেখ করেছেন পাশ্চাত্য তো সাম্প্রতিক কাল পর্যন্ত ভারতকে অনুনয় করেছে মিয়ানমারের সামরিক সরকারকে একঘরে এবং দেশটির সাথে অর্থনৈতিক লেনদেন বন্ধ করতে। এখন আবার ওই পশ্চিমারাই তাদের নিজ স্বার্থে মিয়ানমারে বিনিয়োগ করতে নিজেরাই ছুটছে। ভারতীয়রা মনে করে, এমন পরিস্থিতি আগামী কয়েক বছরে পশ্চিমাদের জন্য ইরানেও বিরাজ করবে।
লেখক : অবসরপ্রাপ্ত ব্রিগেডিয়ার এবং নিরাপত্তা, রাজনীতি, বৈদেশিক নীতি ও আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিশ্লেষক

বুধবার, ১৬ মে, ২০১২

দুঃসময়ের বন্দনাবিলাস


॥ এম. আবদুল হাফিজ ॥


নেতৃস্থানীয় যে কেউÑ তা সে রাজনৈতিক, শিক্ষা অথবা সংস্কৃতি অঙ্গনেই হোকÑ তার জন্য চাই হলভর্তি অথবা মাঠজুড়ে দর্শক শ্রোতার উপস্থিতি। শুধু উপস্থিতি নয় তাদের আবার হতে হবে বিশিষ্ট ও গুণীজন। শুধু তাহলেই নেতৃস্থানীয়দের ম্যাগনাম অপোসগুলোর সৃষ্টি সম্ভব। বন্দনাবিশারদ স্তাবকেরা সেই সৃষ্টি সম্ভব করতে প্রাণান্তকর চেষ্টা করেন। সমুদ্র জয়ের জন্য প্রধানমন্ত্রীকে নাগরিক সংবর্ধনা দেয়ার অনুষ্ঠানটি আপনারা অনেকে উপভোগ করে থাকবেন। আমাদের মতো সাধারণ্যের অবশ্য ওই সব এলিট অনুষ্ঠানে কদাচিত প্রবেশাধিকার ঘটে। তবু টেলিভিশনের বদৌলতে আমরাও দেশরতেœর অমৃতবাণী শ্রবণের সৌভাগ্য অর্জন করি কখনো কখনো।
আমাদের প্রধানমন্ত্রীর এ সব সংবর্ধনা গ্রহণেরও প্রচুর ধৈর্য ও স্ট্যামিনা রয়েছে। তার সব অর্জনের পেছনে তার পরিবারগত অবদান ও পিতার শিক্ষা কতটা কাজ করে সে সব তিনি এত সুন্দর করে গুছিয়ে বলতে পারেন। তা ছাড়া একটি অস্থিতিশীল দেশের অস্থিরতা ও উত্তেজনার মধ্যে তিনি আদৌ এই অনুষ্ঠানগুলোতে পৌরহীত্য যে করতে পারেন তা-ও তার প্রতিভারই স্বাক্ষর। একটি আন্দোলন হরতাল বিধ্বস্ত দেশেও তিনি এত কিছুর শীর্ষে থাকতে পারেন তা-ও এক বিস্ময়। অবশ্য নিন্দুকেরা বলে সে ক্ষমতার মোহ তাকে অনেক অসাধ্য সাধনে সাহায্য করে। আর পেছনে তো রয়েছেই তার স্তাবকের বহর যারা নিরন্তর তাকে প্রেরণা দিতে থাকে। তবে আমার মতো আবেগাপ্লুত মানুষের কাছে তার এত কিছুতে জড়িয়ে থাকা কিছুটা ক্রুরই লাগে।
এ সব মতলববাজিতে কি সত্যিই ক্ষমতার মেয়াদকে প্রলম্বিত করা যায় বা ক্ষমতা কুক্ষীগত করা যায়? অনেকেই সে চেষ্টা করতে কসুর করেননি। কিন্তু শেষরক্ষা হয়নি। এই নাতিদীর্ঘ জীবনে তো রাজনীতির খেলা কম দেখলাম না। আইয়ুব খাঁ যখন সাড়ম্বরে তার শাসনের অর্জন একটি ডিকেড অব প্রগ্রেস উদযাপনে লিপ্ত হলেন, তারই অতিপ্রিয় এবং বিশ্বাসী একজন জুলফিকার আলী ভুট্টো তাসখন্দ চুক্তিকে কেন্দ্র করে আইয়ুব খাঁর মুখোমুখি হলেনÑ এবার একজন প্রতিপক্ষের ভূমিকায়। শেষচেষ্টা করেও আইয়ুব খাঁর আর বৈরী রাজনৈতিক ঝড়ে আর মেরুদণ্ড সোজা করে দাঁড়াতে পারেননি।
একজন রেজাশাহ পাহলভি। ইরানে তার ক্ষমতার সূর্য যখন মধ্যাহ্ন গগনে কুলমান সচেতন এই নরপতি তার রাজবংশের পাঁচ হাজার বছর পূর্তিতে প্রাচীন রাজধানী পার্সিপলিসে তাবৎ পৃথিবীর রাজন্যদের জমায়েত করতে এক ধ্বংসাবশেষের ওপরই তৈরি করেছিলেন এক চোখধাঁধানো প্রাচীন রাজধানী। দাম্ভিক এই নরপতি পারস্যের জন্য অনেক বেশি বড় ছিলেন বলে মনে করতেন। মার্কিন স্বার্থের আনুকূল্যে তিনি পারস্যকে একটি আঞ্চলিক শক্তিতে পরিণত করতে চেয়েছিলেন, যা হবে মার্কিন আনুকূল্যে পরমাণু অস্ত্রসজ্জিত একটি দেশ যা ওই সময়ে উপসাগরীয় অঞ্চলের পুলিশম্যান বলে স্বীকৃতিও পেয়েছিল।
পার্সিপলিসের স্বপ্নাবেশ কাটবার আগে বেরসিক আয়াতুল্লাহরা শাহর পায়ের তলার মাটি সরিয়ে ফেললেন। একজন নিরুপায় রেজাশাহ পাহলভি কোনোমতে তেহরানের উপকণ্ঠে মেহরাবাদ বিমান বন্দর থেকে একটি অপেক্ষমাণ বিমানে করে পালিয়ে বাঁচলেন। ভাগ্যিস তিনি একজন বৈমানিক ছিলেন। ইরানের মাটি থেকে উড়াল দেয়ার সময় তার চোখ অশ্রুসিক্ত ছিল।
এই সে দিন পর্যন্ত আধুনিক মিসরের ফারাও হোসনি মুবারক জনরোষের প্রাক্কালে ব্রিটেনে পালিয়ে যাওয়া পুত্রকে তার পদে স্থলাভিষিক্ত করার ফন্দি আঁটছিলেন। তাহরির স্কোয়ারের গর্জনে মরুঝড়ের ঝাঁপটায় তছনছ হয়ে যায় সব কিছু। তার সব অপকর্মের সাথী স্ত্রী সুজান মুবারককে নিয়ে কায়রো থেকে পালিয়ে বাঁচেন। পরে আসামি হিসেবে প্রিজনভ্যানে আবার কায়রোয় এসেছিলেন এই অশীতিপর ক্যান্সার আক্রান্ত এক কালের দীর্ঘতম সময়ের মিসরীয় প্রেসিডেন্ট।
আমাদের নেতানেত্রীদের আচরণ উচ্চারণে মনে হয় না যে তাদের কোনো পতন হতে পারে। ক্ষমতার সাথে বিচ্ছিন্নতার কোনো প্রসঙ্গকে তারা সযতেœ এক পাশে সরিয়ে রেখে তারা বারবার নিজেদের অপরিহার্যতার প্রসঙ্গই টেনে আনেন। দেশ এখন কোনো স্বাভাবিক অবস্থায় নেই। লোডশেডিংয়ের দংশনে আমরা ভুক্তভোগীরা যখন ঘামে ভেজা শয্যায় এপাশ-ওপাশ করতে থাকি, কখন যে ডিজিটাল বাংলার স্বপ্ন উবে যায় এবং একটি তিক্ত অস্বস্তিকর অনুভূতি আমাদের ছেয়ে ফেলে! অর্ধেকের বেশি সময় বিদ্যুৎবঞ্চিত থাকা সত্ত্বেও মাসের বিদ্যুৎ বিল যে কিভাবে তিন-চার গুণ স্ফীত হয়ে যায় অঙ্কে দুর্বল আমি সে হিসাবও বুঝি না। ভয়ে ভয়ে যত শিগগির পারি নিজের প্রয়োজনীয় অনেক কিছুকে পেছনে ফেলে রেখে এই বিল পরিশোধকেই অগ্রাধিকার দেই। 
লেখক : অবসরপ্রাপ্ত ব্রিগেডিয়ার এবং নিরাপত্তা, রাজনীতি, বৈদেশিক নীতি ও আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিশ্লেষক

রবিবার, ১৩ মে, ২০১২

সরকার ও ১৮ দলীয় জোট : উভয়ের শূন্যগর্ভ আস্ফালন

চাকরিজীবনের ঊষালগ্নে চাকরিতে জ্যেষ্ঠদের কাছ থেকে প্রায়ই একটি আপ্তবাক্য শুনতাম : Honest work, Modest talk, বাংলায় যার ভাবার্থ দাঁড়ায়- উচ্চবাচ্য নয়, নিবিষ্ট মনে কাজই লক্ষ্য। সম্প্রতি দেশে আইনশৃঙ্খলা সংশ্লিষ্ট কিছু ব্যর্থতার চিত্র উঠে এসেছে। লোকে মনে করে- সততা, আন্তরিকতা ও নিষ্ঠা সাপেক্ষে সেগুলোতে সাফল্য অর্জন অসম্ভব নয়। দেশের বর্তমান দমননীতি ও মামলা-হামলায় জর্জরিত করে বিরোধী দল ও ভিন্নমতাবলম্বীদের কণ্ঠরোধ হলেও সাংবাদিক সম্প্রদায় ও বহুল আলোচিত সাগর-রুনির স্বজন এবং দেশের আপামর জনসাধারণ এই সাংবাদিক দম্পতি হত্যাকাণ্ডের দায়সারা তদন্ত ও তাতে অযৌক্তিক দীর্ঘসূত্রতা কর্তৃপক্ষের আন্তরিকতা ও নিষ্ঠাকে প্রশ্নবিদ্ধ করেছে। স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী যে ইস্যুতেই মুখ খুলেছেন বা তর্জনগর্জন করেছেন, তা সে সুরঞ্জিতের এপিএসের ড্রাইভারের ব্যাপারেই হোক বা সৌদি কর্মকর্তা খালাফের হত্যাকারী শনাক্ত করতেই হোক অথবা দেশ কাঁপানো ইলিয়াস নিখোঁজই হোক- মন্ত্রী মহোদয়ার সব দাবি ও আশ্বাস শূন্যগর্ভ প্রমাণিত হয়েছে। তিনি শুধু ধৈর্যধারণের পরামর্শ দিয়েছেন এ পর্যন্ত। কোনোটার জট খুলতে পারেননি তাঁর মন্ত্রণালয় বা তিনি।
তবে হ্যাঁ, সাফল্য তো তাঁর এক জায়গায় অনস্বীকার্য। সেটা বিরোধী দলকে ঠেঙানোয়। এবং তা এই মাত্রায় যে বিরোধী দল জনদুর্ভোগের অপবাদ নিয়ে হরতাল করলেও তা ছিল হরতালের নামে ইঁদুর-বিড়ালের লুকোচুরি। তাঁর আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর বদৌলতে ১৮ দলীয় জোট না পেরেছে হরতালের প্রতীকী চিহ্ন রাজপথে মিছিল বের করতে বা কোনো জমায়েত করে বক্তব্য দিতে। তাঁর দায়িত্ব যদিও নিরপেক্ষভাবে শৃঙ্খলা বজায়, তাঁর বাহিনী কিন্তু তাঁর দলের লাঠিয়ালদের সঙ্গে একীভূত হয়ে যৌথ বাহিনীর অ্যাকশনে প্রবৃত্ত হয়েছে। তবু এর জন্যও হয়তো তাঁর কৃতিত্ব প্রাপ্য এবং তাতে কেউ কোনো আপত্তি করত না, যদি তিনি একই রকম দক্ষতার সঙ্গে ওপরে আলোচিত ব্যর্থতাগুলো ঠেকিয়ে বিষয়গুলোর একটি সুরাহা করতে পারতেন।
কিন্তু তেমনটি হয়নি। কেননা স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী মহোদয়াকে তো দলের স্বার্থও সংরক্ষণ করতে হবে। জাতি ও জনগণের স্বার্থ মুলতবি থাকতে পারে। কিন্তু তাঁর দলের স্বার্থে দলকে অগ্রাধিকার দিয়ে তাঁকে আনুগত্য প্রকাশ করতে হবে। সাগর-রুনি থেকে শুরু করে অধুনা ইলিয়াসের নিখোঁজ ইস্যু পর্যন্ত- সব কিছুকে তিনি দুর্ভেদ্য চাদরে ঢেকে দিয়েছেন। তিনিসহ সরকারি দলের ধারণা হয়তো এই- দীর্ঘসূত্রতার মাধ্যমে সেগুলোকে গণমানস থেকে মুছে দিতে পারলেই সম্ভবত কেল্লাফতেহ। এই ইস্যুগুলোর কাঁটা থেকে তাঁদের আগামীর পথ নিষ্কণ্টক হবে।
তা হবে কিছু সময়ের জন্য। আমি সব সময়ই বলি যে আন্দোলন-বিক্ষোভ প্রশমিত করতে একটি সরকারের অনেক অস্ত্র হাতে থাকে, যা একটি সরকার একের পর এক প্রয়োগ করতে পারে না। এই যে সরকার বিরোধী দলের আন্দোলন ঠেকাতে তার দমননীতি প্রয়োগ করল, তাতে অভিনবত্ব খুব একটা নেই। অতীতে সেই পাকিস্তান আমল থেকে বহুবার তা প্রয়োগ হয়েছে। অনেকের দৃষ্টিতে হরতাল যেমন 'ভোঁতা' হয়েছে, তেমনি হয়েছে দমননীতি। আওয়ামী লীগের চেয়ে তা ভালো করে আর কেউ জানে না।
এই পর্যায়ে বিএনপি নেতা-কর্মীরা গা-ঢাকা দিয়ে পালিয়ে থাকবেন কিছুদিন। অতঃপর পুনঃসংগঠিত হয়ে মাঠে নামবেন। আমাদের পুরো স্বাধীনতা সংগ্রামটিই তো এভাবেই এগিয়েছিল। আওয়ামীরা কি তা জানে না? তা ছাড়া ১৮ দলীয় জোট তো সবেমাত্র প্রয়োজনীয় কিন্তু অপ্রধান ক্ষেত্রেই তাদের আন্দোলনকে সীমাবদ্ধ রেখেছে। আওয়ামীদের মতো তাদেরও চূড়ান্ত লক্ষ্য ২০১৪ সালের নির্বাচনে বিজয় মুকুট ছিনিয়ে আনা।
এ কথা মনে রাখতে হবে যে বড় দুই দলের যেকোনো একটিকে ছাড়া এ দেশে অভ্যন্তরীণ ও আন্তর্জাতিকভাবে গ্রহণযোগ্য কোনো নির্বাচন হবে না। কিভাবে কার অধীনে সে নির্বাচন হবে, সে ইস্যুতে কিন্তু এখনো কোনো ঐকমত্য প্রতিষ্ঠিত হয়নি। কিন্তু সরকার ইতিমধ্যেই একতরফাভাবে সাংবিধানিক সংশোধনী এনে তাদের অধীনেই নির্বাচন অনুষ্ঠানের ফন্দিফিকির করছে। এদিকে বিএনপির ধনুক ভাঙ্গা পণ যে তত্ত্বাবধায়ক সরকার পুনর্বহাল ছাড়া তারা নির্বাচনে যাবে না। চলমান অন্তর্দলীয় বিবাদে এটাই হলো কেন্দ্রীয় ইস্যু। একটি গতানুগতিক আলটিমেটাম বিএনপির তরফ থেকে দেওয়া থাকলেও এই ইস্যুতে কিন্তু এখনো আন্দোলন 'লাগাতার হরতাল'-এর পর্যায়ে পৌঁছেনি।
সমস্যা যে বড় দুটি দলের জন্যই। এই নির্বাচন পদ্ধতির বিতর্কে উভয়ের অস্তিত্বের প্রশ্ন জড়িত। সন্দেহ নেই যে বিএনপির অতীত ট্র্যাক রেকর্ড ভালো নয়। তাই তারা ক্ষমতা আঁকড়ে থাকার নীলনকশা বানিয়েও শেষ পর্যন্ত জনরোষে পতিত হয় এবং ক্ষমতার বলয় থেকে ছিটকে পড়ে। আওয়ামী লীগের জন্য পরিহাসেরই বিষয় যে বিএনপির এত বড় বিপর্যয় থেকে তারা কোনো ধরনের শিক্ষা গ্রহণ না করে ওই একই পরিত্যক্ত পথ মাড়িয়েছে এবং প্রকাশ্য জনরোষে না পড়লেও একটি প্রচণ্ড বৈরী রাজনৈতিক ঝড়ের মুখে যে তারা পড়তে যাচ্ছে, তা তারা বুঝতে পেরেছে এবং সস্তা কিরাকসমে প্রবৃত্ত হয়েছে। অবিকল বিএনপি নেত্রীর স্টাইলে ভাষা ও শব্দচয়ন অবিকৃত রেখে শেখ হাসিনা জনতার উদ্দেশে বলে চলেছেন একই কথা। বলছেন যে তিনি তাঁর মেয়াদে বিভিন্ন খাতে কী অসাধ্য সাধন করেছেন, যা চলমান থাকবে- যদি তিনি তাঁর দলকে নিয়ে আবার ক্ষমতায় আসতে পারেন। সহস্রাব্দের প্রথম দশকে ম্যাডাম জিয়াও 'উন্নয়নের ধারা' অব্যাহত রাখতে তাঁকেই পুনর্নির্বাচিত করার কথা বলতেন। কিন্তু জনগণ ভ্রূক্ষেপও করেনি।
হায় রে ডিজিটাল বাংলাদেশ, ২০২০ সাল নাগাদ বাংলাদেশের মধ্যম আয়ের দেশে পরিণত হওয়া এই ললিপপগুলো আমারও চুষতে ইচ্ছে করে। জানি না, অত দিন হয়তো বাঁচব না, তবে বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ নেতৃত্ব যে পথে হাঁটছে, তা দেখতে বাঁচারও বড় একটা ইচ্ছা করে না। রাজনীতির আরো বিকৃতি দেখতে কারো সে ইচ্ছা করবে না।
সাগর-রুনির ভাগ্য, নিখোঁজ ইলিয়াসকে নিয়ে তাঁর পরিবারের শঙ্কা, দেশজুড়ে হত্যা, গুম ও নৃশংসতা যদি এ দেশের বাস্তবতা হয়- সেই বাস্তবতাকে পাল্টানোর উদাত্ত আহ্বান জানিয়ে বলতে ইচ্ছা করে, শীর্ষ নেত্রীদ্বয়ের বস্তাপচা রাজনীতি ও দেশ শাসন থেকে আমাদের মুক্তি হোক। গণতন্ত্রের মানসপুত্র সোহরাওয়ার্দী, মুক্ত বাংলার ব্যাঘ্র কৃষক-বন্ধু এ কে ফজলুল হক এবং বঙ্গবন্ধুর মতো সুসাহসী নেতাদের দেশ ১৬ কোটি মানুষের আবাসভূমি এই বাংলাদেশে আমরা কি এর চেয়ে একটু প্রজ্ঞাবান দূরদৃষ্টিসম্পন্ন নেতৃত্ব পাওয়ার বা তৈরি করার যোগ্যতা রাখি না?

লেখক : সাবেক মহাপরিচালক,
বিআইআইএমএস ও কলামিস্ট

এক্সপেরিমেন্ট অব্যাহত


এম আবদুল হাফিজ
দু-দু'জন বিশিষ্ট বিদেশি ঘুরে গেলেন বাংলাদেশ। তাদের আসার উদ্দেশ্য সম্পর্কে বড়জোর ঝাপসা ধারণাই দেওয়া হয়েছিল দেশবাসীকে। তাই তারা কৌতূহলোদ্দীপ্ত হয়ে শুধু শুধু শাসকদের আতিথেয়তা ও আচার-অনুষ্ঠান টিভির পর্দায় দেখেছে এবং সাতপাঁচ ভেবেছে এবং এখনও ভাবছে। ইত্যবসরে একমাত্র পরাশক্তি যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্রমন্ত্রী হিলারি ক্লিনটন হয়তো এখন নিজেদের স্বার্থরক্ষায় অন্য কোনো স্ট্র্যাটেজিক স্পটে দাবার চাল নির্ধারণে ব্যস্ত। হয়তো মধ্যপ্রাচ্যে, হয়তো ইউরোপে। পূর্ব ইউরোপে ক্ষেপণাস্ত্র মোতায়েনে বড্ড জ্বালাতন করছেন রুশরা।
হিলারি অবশ্য শুধু বাংলাদেশকে উদ্দেশ করেই এদেশে আসেননি। ভৌগোলিকভাবে দক্ষিণ এশিয়ার অন্তর্ভুক্ত হলেও পশ্চিমারা এদেশকে একটি বৃহত্তর এশিয়া-প্যাসিফিক অঞ্চলের স্ট্র্যাটেজিক বলয়েও খানিকটা প্রাসঙ্গিকতা দেয়। পাশ্চাত্যের জন্য সমস্যা হয়েছে যে, বিশ্বের নতুন ভরকেন্দ্র ক্রমেই ইউরোপ থেকে যুক্তরাষ্ট্র এবং এখন এশিয়া-প্যাসিফিকে স্থানান্তরিত হচ্ছে। অর্থনীতি, ব্যবসা-বাণিজ্য এবং শিল্প ও উৎপাদনে আগামী দিনগুলোতে এই অঞ্চলই বিশ্বকে প্রভাবিত করতে চলেছে। এখানেও পশ্চিমা স্বার্থের প্রতিকূলে চীনের অপ্রতিরোধ্য উত্থান অন্তত যুক্তরাষ্ট্রের মতো একক পরাশক্তি মেনে নিতে পারছে না। তাই নানা কৌশলের আশ্রয় গ্রহণ এবং অবস্থানের বিন্যাস ও পুনর্বিন্যাস।
এই স্ট্র্যাটেজিক বিন্যাস ও পুনর্বিন্যাসের মূল খুঁটি ভারত হলেও একে নিশ্ছিদ্র করতে ভৌগোলিক ও স্ট্র্যাটেজিক অবস্থান সাপেক্ষে বাংলাদেশের মতো ক্ষুদ্র দেশগুলোও গুরুত্বপূর্ণ। ওয়াশিংটন থেকে প্রকাশিত 'ফরেন অ্যাফেয়ার্স' পত্রিকাটিতে হেনরি কিসিঞ্জার রচিত এক সাম্প্রতিক নিবন্ধে চীনকে পরিবেষ্টনের নীতিকে জোরালো সমর্থন দেওয়া হয়েছে। এই নীতি বাস্তবায়নে ভারতসহ দক্ষিণ এশীয় দেশগুলোর একটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রয়েছে।
সেই লক্ষ্যেই ক্ষুদ্র এবং একটি ব্যর্থ সরকার শাসিত দেশকেও 'গুড হিউমারে' রাখতে হয়। আসতে হয় রুডইয়ার্ড কিপলিং বর্ণিত 'কমজাত'দের দেশে। এসেই যখন পড়া, তখন তো কিছু কিছু চবঢ় ঃধষশং এ দেশবাসীকে অভিভূত করারও সুযোগ হয়। শাসক শ্রেণীরও একজন হিলারি বা প্রণব মুখার্জির সফরের চমকে দেশের কদর্য বাস্তবতাকে দেশের জনগণের দৃষ্টি থেকে কিছু সময়ের জন্য হলেও সরিয়ে রাখা যায়। এসব সফর তাদের জন্য নেহাতই রুটিন এবং কোনোক্রমেই তার মধ্যে তাত্তি্বক কোনো কিছু আবিষ্কারের অবকাশ নেই।
বৃহৎ বা উদীয়মান বৃহৎ শক্তিগুলো কখনও কিছু দিতে আসে না, বড়জোর কিছু নেওয়ার ক্ষেত্র প্রস্তুত করতে আসে। আসে এদেশে সাম্রাজ্যবাদের পয়েন্টম্যানদের সঙ্গে নিভৃত আলাপচারিতায় লিপ্ত হতে। হিলারির সঙ্গে প্রণব বাবুর সফর কাকতালীয় হতে পারে। কিন্তু তারা উভয়েই প্রকারান্তরে একই প্রকার স্বার্থের প্রতিভু। বিশ্লেষকদের ফোকাস যুক্তরাষ্ট্রের সাবেক ফার্স্ট লেডির ওপরই অধিক হওয়া সত্ত্বেও অতিথিদ্বয়ের মধ্যে 'বাঙালি' প্রণব মুখার্জিই বাজিমাৎ করেছেন রবীন্দ্রনাথের সার্ধশততম জন্মবার্ষিকীর সমাপ্তি অনুষ্ঠানে। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে আমরা একজন রাষ্ট্রনায়কোচিত বলেই জানতাম। তিনি রবীন্দ্র এবং সংস্কৃতি বিষয়ক অনুষ্ঠানমালার ভেতর দিয়ে ভিন্ন সত্তায়ও নিজকে প্রকাশ করেছেন। তিনিও তার ভারতীয় অতিথির সঙ্গে কবিতা আবৃত্তি করেছেন এবং উপনিষদভিত্তিক রবীন্দ্রদর্শনেও ব্যুৎপত্তি প্রদর্শন করেছেন। তবে প্রণব বাবু বেরসিকের মতো ছন্দপতন ঘটিয়েছেন সীমান্ত হত্যার প্রসঙ্গ টেনে, যদিও তিনি তার উল্লেখ মুনশিয়ানার সঙ্গেই করেছেন। বলেছেন যে তারা ভারতীয়রাও সীমান্তে অব্যাহত বাংলাদেশি হত্যায় চিন্তিত। এতটাই যে, তারা সীমান্তরক্ষীদের ঘড়হ-খবঃযধষ হাতিয়ারে সজ্জিত করার কথা ভাবছেন। অথবা সীমান্তে সন্ধ্যার পর সান্ধ্য আইন বলবৎ রাখার কথাও বিবেচনায় রয়েছে। তাহলে কি সীমান্তে বাংলাদেশি দেখা মাত্র তাকে গুলি করার বিএসএফের অধিকার অপরিবর্তিতই থাকবে?
প্রয়াত কৃষ্ণস্বামী সুব্রামানিয়াম, যিনি ভারতের স্ট্র্যাটেজির গুরু বলে অভিহিত হতেন, একাধিকবার বলতে শুনেছি যে অস্ত্র থাকলেই তা ব্যবহৃত হতে হবে এমন কোনো কথা নেই। ক্ষুদ্রাস্ত্র থেকে পারমাণবিক অস্ত্র পর্যন্ত সব রকম হাতিয়ারের ব্যবহার নির্ভর করে সম্পর্কের ওপর। ইউরোপের অপেক্ষাকৃত স্বল্প পরিসরে তিনটি পারমাণবিক অস্ত্র সজ্জিত দেশ আছে, কিন্তু তারা কখনও পারমাণবিক যুদ্ধে লিপ্ত হয়নি।
যে কোনো সশস্ত্র বাহিনীর কমান্ড ও কন্ট্রোলকে উপেক্ষা করে অস্ত্রের প্রয়োগ প্রবণতা তখন জন্মে, সম্পর্ক যখন সম্ভবত একপক্ষের 'হৃদয়ের টানের' ওপর প্রতিষ্ঠিত।


ব্রিগেডিয়ার (অব.) এম আবদুল হাফিজ : সাবেক মহাপরিচালক বিআইআইএসএস ও কলাম লেখক

শুক্রবার, ১১ মে, ২০১২

ইলিয়াস ইস্যুতে আন্দোলন ঠেকিয়ে আওয়ামী লীগের লাভ?








এম আবদুল হাফিজ


বিরোধী দলের চলমান আন্দোলনের কেন্দ্রীয় চরিত্র ইলিয়াস আলীর অবস্থান অপরিবর্তিত। তিনি অমাবস্যার চাঁদের মতো এখনও দেশবাসীর দৃষ্টিসীমার অš—রালে। ইতিমধ্যে ইলিয়াস আলীর স্ত্রী ও সš—ানরা প্রধানমন্ত্রীর বদান্যতায় তার সঙ্গে সা¶াতেরও সুযোগ পেয়েছেন, যদিও সরকারি তথ্যমতে ইলিয়াস আলীর সন্ধান সর্বোচ্চ অগ্রাধিকারের ভিত্তিতেই এগোচ্ছিল। একজন ডুবš— মানুষ খড়কুটো আঁকড়ে ধরেও বাঁচতে চায়। ইলিয়াসের স্ত্রী সম্ভবত প্রধানমন্ত্রীর মধ্যে সেই খড়কুটোই দেখতে পেয়েছিলেন। প্রধানমন্ত্রী ইলিয়াস আলীর স্ত্রীকে সদয় সহানুভ‚তির সঙ্গে সা¶াৎকার দেন এবং একজন ভুক্তভোগীর মানসিকতা থেকে ইলিয়াসকে উদ্ধারের আশ্বাস দেন। সেই আশ্বাস নিয়ে ইলিয়াসপতœী ফিরে এলেও এ নিয়ে জল্পনার অš— নেই। 
সমগ্র দেশবাসীর মনে এখন একথাই ঘুরপাক খাচ্ছে যে, সব সদিচ্ছা নিয়েও কী করতে পারেন প্রধানমন্ত্রী, যদিও তিনিই দেশবাসীর জন্য সর্বোচ্চ আশাভরসার স্থল। তাছাড়া এর কি গ্যারান্টি আছে যে আল­াহ না কর“ন ইলিয়াস এখন সব উদ্ধার প্রচেষ্টার ঊর্ধ্বে নন। ক’দিন আগে ওসমানী মিলনায়তনের এক অনুষ্ঠানে শ্রম প্রতিমন্ত্রী মন্নুজান সুফিয়ান ইলিয়াস পতœীকে ‘বিধবা’ বলে আরেক বিতর্কের জš§ দিয়েছেনÑ তাও আবার প্রধানমন্ত্রীর উপস্থিতিতে। গণভবনে ইলিয়াসকে উদ্ধারের আশ্বাসদানকালেও কিন্তু প্রধানমন্ত্রীর বডি ল্যাংগুয়েজ খুব একটা উৎসাহব্যঞ্জক মনে হয়নি। 
তবে একেবারে হঠাৎ করে না হলেও দেশের রাজনৈতিক দৃশ্যপট বেশ পরিবর্তিত। প্রতীয়মান হয় যে, সরকার বুঝে-সুঝেই হার্ডলাইনে চলে গিয়েছে। বিগত দিনগুলোতেও সরকার রাজপথে মারমুখো ছিল। কিন্তু এখন নীতিগতভাবেই সরকার হার্ডলাইনে, যা সরকারের প্রায় অšি—ম সময়ে সার্বিক পরিস্থিতি বিচারে একটি দমননীতিরই অংশ। এতদিন তবু কিছু রাখঢাক ছিল, কিন্তু এখন নমনীয়তার যেটুকু বাকি ছিল তারও মুখোশ খুলে ফেলে সরকার সর্বাÍকভাবেই ১৮ দলীয় জোটকে মোকাবেলা করতে চায়। এই জোটটি যখন সতর্কভাবে এগোচ্ছিল এবং জনগণের হরতালে সহ্যশক্তির তোয়াক্কা করে এবং বিদেশী বিশিষ্টজনদের সফরকে ঘিরে সাবধানী কর্মসূচি দিতে যাচ্ছিল, তখনই সরকার শীর্ষ নেতাদের অজামিনযোগ্য বিস্ফোরক মামলায় জড়িয়ে পুরো আন্দোলনেরই টুঁটি চেপে ধরতে উদ্যত হয়েছে। এভাবেই রাজপথকে নিজেদের দখলে রেখে মাত্র ক’জন বিএনপি নেতাকে এখন পর্যš— পুলিশের সাঁড়াশিমুক্ত রাখলেও তারা দলীয় নেতাদের জামিন ইত্যাদি আইনি হয়রানিতে আদালত প্রাঙ্গণেই নাভিশ্বাসগ্র¯—। 
যে কোন ¶মতাসীন দলের প¶ে জনমতে যখন ধস নামে, বিষয়টি তখন এমনই রূপ পরিগ্রহ করে। বলাই বাহুল্য আগামীতে এ রূপ আরও কদর্য হবে। ফলে উদ্ভ‚ত ডামাডোলের মধ্যে কোথায় ছিটকে পড়েছে বা পড়বে ইলিয়াস উদ্ধারের আন্দোলন। অতীতের অভিজ্ঞতা সা¶ী যে, এরও মধ্যে আন্দোলনের চালিকাশক্তি গজিয়ে ওঠে। এক দ্বার র“দ্ধ হলে অন্য দ্বার খুলে যায়। ঠিক আমাদের মহান ¯^াধীনতা সংগ্রামের মতো। তখনও সংগ্রামে উত্থান-পতন হয়েছে। 
তাছাড়া রাজনীতির ময়দানে টিকে থাকার লড়াই কোন সহজসাধ্য ব্যাপার নয়। তবু অনেকের দৃষ্টিতে বিএনপি তার সব কলঙ্ক নিয়ে শুধু আওয়ামী লীগের গোয়ার্তুমির বদৌলতে এক দীর্ঘমেয়াদি লড়াইয়ের প্রথম ধাপগুলো বেশ সাফল্যের সঙ্গে উৎরে এসেছে। অধুনা আরোপিত দমননীতির মামলা-হামলায় অভিযুক্তরা রাজনীতি বিশেষ করে মাঠের রাজনীতি এবং নেতৃত্ব দেয়ার ¶েত্রে পরিপক্ব হয়ে বেরিয়ে আসবে এবং এ প্রক্রিয়া তাদের বাড়তি আÍবিশ্বাসও দেবে। 
কিন্তু প্রশ্ন থেকেই যায় যে, তাহলে ইলিয়াস উদ্ধারের আন্দোলন কোন ভাগ্য বরণ করবে। ইলিয়াসের ধরাধামে অ¯ি—ত্ব নিয়েই যখন প্রশ্ন উঠেছে, আসলেই ইলিয়াস বা ইলিয়াসকে ঘিরে আন্দোলনের কী পরিণতি দাঁড়াবে? ইলিয়াসের যাই ঘটে থাকুক না কেন বা তার সমাপ্তি যেভাবেই ঘটুক, আন্দোলনের মূল ইস্যু কিন্তু রয়েই গেছে। তা হল একটি দলনিরপে¶ তত্ত¡াবধায়ক সরকারের অধীনে আগামী সাধারণ নির্বাচন। এ ইস্যুতে তো আগামী জুন মাসের প্রথম বা দ্বিতীয় সপ্তাহ পর্যš— বিএনপির সেই শর্ত পূরণের আলটিমেটাম দেয়াই আছে। সে ইস্যুতে মূল আন্দোলনে ইলিয়াস ছিল ছিটকে পড়া স্ফুলিঙ্গ। আন্দোলনের পথে চলতে এমনি হয়তো আরও একাধিক স্ফুলিঙ্গ ছিটকে বেরিয়ে আসবে। তাই একটি দমননীতির মাধ্যমে ইলিয়াস গুমের বির“দ্ধে আন্দোলন ¯—ব্ধ করে দেয়ার মধ্যে আওয়ামী লীগের বিশেষ কোন রাজনৈতিক প্রাপ্তি নেই। 
বিএনপি নেতৃত্বাধীন ১৮ দলীয় জোট বনাম আওয়ামী লীগ নেতৃত্বাধীন মহাজোট। রাজনীতির ¶মতার খেলায় এদের খেলাটির কিন্তু কোন ব্যত্যয় ঘটবে না, যদিও মাঝখান থেকে একজন খেলুড়ে ইলিয়াস হয়তো থাকবে না। সে¶েত্রে কিছু বিন্যাস সাপে¶ে নতুন সমীকরণ তৈরি হতে পারে, যা পূরনো সমীকরণের চেয়ে ১৮ দলীয় জোটের জন্য ভালো হতে পারে। আওয়ামী লীগ ইচ্ছে করলেও এতে তাদের অনুক‚লে শক্তির ভারসাম্য আনতে পারবে না। যে কোন বিচারে আমাদের রাজনৈতিক অঙ্গনে প্রাক-নির্বাচন জটিলতাগুলো রয়েই গিয়েছে। 
আওয়ামী লীগ তাদের শাসনের মেয়াদ ফুরিয়ে যাওয়ার প্রাক্কালে মনোবৈকল্যে ভুগছে, যার খেসারত হয়তো কিছু নির্দোষ নিরপে¶ ব্যক্তি বা গোষ্ঠীকে দিতে হবে। ২০০০ সালের প্রথম দশকের শেষ ভাগে বিএনপিও এমন øায়ুবৈকল্যে ভুগেছিল, যার পরিণতিতে আমাদের রাজনীতি কলুষিত হয়েছিল। চাইলে আওয়ামী লীগ সেই রাজনীতিকে একটি বিশোধন প্রক্রিয়ায় নিয়ে একটি সম্পূর্ণ নিষ্কলুষ রাজনৈতিক ধারার উদ্ভব ঘটাতে পারত। সেই অভিজ্ঞতা ও প্রয়োজনীয় উপাদানগুলো তাদের মধ্যে ছিল। শুধু তাদের মহানুভবতার মিশ্রণ ঘটানোর দরকার ছিল তাতে। কিন্তু ওই যে বঙ্গবন্ধুর বহুল উচ্চারিত আপ্তবাক্য, চোরা না শোনে ধর্মের কাহিনী। মহৎ কিছু রাজনৈতিক রূপাš—র শুধু মানসিকতার ব্যাপার। 
সুযোগ বিএনপি বা আওয়ামী লীগ উভয়ের কাছেই এসেছিল পর্যায়ক্রমে। কিন্তু উভয়েই রয়ে গেল নির্মমভাব ইতিহাসবিমুখ। তারা শুধু এক ক্লেদাক্ত বর্তমানকেই আঁকড়ে ধরে থাকল। তাদের রাজনীতির উজ্জ্বলতম মুহূর্তগুলো এমনিভাবেই তাদের হাতছাড়া হয়ে গেল। অবশ্য আওয়ামী লীগের এখনও সময় আছে বা¯—বতার নিরিখে রাজনীতির মান নিরূপণের। আমাদের প্রধানমন্ত্রীকে তার দলীয় সমর্থকরা রাষ্ট্রনায়কোচিতরূপে দেখে। রাষ্ট্রনায়করা কিন্তু নগদ প্রাপ্তিকেÑ তা যতই আকর্ষণীয় হোকÑ তুড়ি মেরে ইতিহাসে তাদের স্থান খোঁজে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে মিত্রবাহিনীর বিজয়ের অন্যতম স্থপতি চার্চিলকে ব্রিটিশ জনগণ যুদ্ধকালীন নির্বাচনেই প্রত্যাখ্যান করেছিল। নোবেল পুরস্কার বিজয়ী এই রাষ্ট্রনায়ককে কিন্তু ইতিহাস প্রত্যাখ্যান করতে পারেনি। 
দেশের চলমান রাজনীতির যেদিকেই বাঁকপরিবর্তন হোক, ইলিয়াস উদ্ধারের নৈতিক দায়িত্ব কিন্তু আওয়ামী সরকারের ঘাড় থেকে অপসারিত হবে না। এটি মানবিক ইস্যু। যে কোন মূল্যে এর সঙ্গে রাজনীতির তিল পরিমাণ মিশ্রণ সর্বতোভাবে পরিত্যাজ্য। প্রধানমন্ত্রী নিজে এই ইস্যুর মানবিক ডাইমেশনকে উপে¶া করেননি। আমরা অধীর আগ্রহে তাকিয়ে আছি শুধু দেখতে যে, আপাতভাবে অনিশ্চিত এই ইস্যুর দুর্ভেদ্যতা ভেদ করে প্রধানমন্ত্রী ইতিহাসে তার স্থান নিশ্চিত করবেন। অতঃপর রাজনীতি চলতে থাকবে তার আপন বৃত্তে। কেউ হারবে, কেউ জিতবে, যার চ‚ড়াš— সমাপ্তি ঘটে শেষ পর্যš— তুচ্ছাতিতুচ্ছের ভেতর দিয়েই। 
এম আবদুল হাফিজ : নিরাপত্তা বিশে­ষক ও কলাম লেখক

রবিবার, ৬ মে, ২০১২

নির্বোধ মার্কিনিদের হিন্দুকুশ আঁকড়ে থাকার স্বপ্ন




॥ এম. আবদুল হাফিজ ॥

আমেরিকানেরা সত্যিই কি এত নির্বোধ! এত দীর্ঘ সময় বিশ্বের সর্বাধিক বিপজ্জনক রণক্ষেত্রে কাটিয়ে এবং তীব্রভাবে গঠিত ও উগ্র স্বভাবসম্পন্ন আফগানদের সংস্পর্শে থেকেও তাদের সাথে লেনদেনের ব্যাপারে কি অবলীলায় প্রলাপোক্তি করে যায়, যা আমরা সম্প্রতিই দেখলাম। পশ্চিমাদের জন্য উপলব্ধি করা কেন এত কঠিন যে বিশ্বাস মানুষের বিশেষ করে মুসলমান ধর্মাবলম্বীদের জীবনে এত কেন্দ্রীয় ভূমিকা পালন করে। যে-কেউ মুসলমানদের তাদের পবিত্র গ্রন্থ কুরআন বহন করতে দেখেছে, অন্তত তাদের এ কথা জানা উচিত। তারা কুরআনকে অত্যন্ত সম্মানের সাথে ধারণ করে এবং যখন তারা অপবিত্র অবস্থায় থাকে, তারা তা স্পর্শও করে না। যখন নিজেদের বিশ্বাসের জন্য সম্মান ও ভালোবাসার প্রশ্ন, আফগানদের চেয়ে কদাচিত অন্য কোনো মুসলমান তা তাদের মতো নিখুঁতভাবে করতে পারে।
গত বছর যখন ডেনমার্কে কুরআন নিয়ে হিংসাপ্রসূত ব্যঙ্গাত্মক তৎপরতা মুসলমানেরা জ্ঞাত হয়, এর সবচেয়ে স্বতঃস্ফূর্ত এবং প্রচণ্ড প্রতিবাদটি হয়েছিল আফগানিস্তানে। সেখানে ক্রোধ ছড়িয়ে পড়ায় অনেকে হতাহতও হয়েছিল। ইতিহাসের পুনরাবৃত্তি হতেই থাকে। সুদূর ফোরিডায় একজন প্রচারপ্রিয় পাদ্রি ঘোষণা দেয় যে, সে ইসলামের ধর্মপুস্তকগুলো পোড়ানোর উৎসব করবে। আফগানেরা শুধু এমন ঘোষণায়ও ক্রুদ্ধ প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করেছিল। আফগানরা কিন্তু এমন প্ররোচনাকে চ্যালেঞ্জ না করে ছাড়ে না। পশতুনওয়ালি ঐতিহ্য তাদের ধমনীতে। ন্যায়ের জন্য তারা মারতে ও মরতে জানে। দেশটিও বৈশিষ্ট্যগতভাবে সাম্রাজ্যের সমাধি বলে পরিচিত।
এই আফগানিস্তানে এক যুগের অধিক সময় কাটিয়েও এখানে প্রায় পাঁচ শ’ বিলিয়ন ডলার ব্যয় করে। এমন তো হওয়ার কথা নয় যে ইয়াংকিরা দেশটি ও তার জনগণের প্রকৃতি এখনো উপলব্ধি করেনি। তাদের বাগরাম বিমানঘাঁটিতে কুরআন পুড়িয়ে ফেলার সাহসকে কি বলা যাবে? নির্বুদ্ধিতা? অনুভূতিহীনতা? অথবা দুটোই? এতে প্রত্যাশিতভাবে কয়েক দিন ধরে মার্কিনিদের গণহারে হত্যাÑ তাও আবার নিরাপদ বিবেচিত স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে তাদের? আফগান সহকর্মীদের হাতে।
অবশেষে প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামা একটি মৃদু কাশি দেয়ার মতো করে একটি ‘ক্ষমা প্রার্থনা’ বা ‘স্যরি’ উচ্চারণ করেন। আফগানিস্তানে তার সামরিক কমান্ডার জেনারেল অ্যালেনও অনুরূপ একটি ‘স্যরি’র ভান করলেন। অ্যালেন অবশ্য সতর্কতামূলক একটি পদক্ষেপ হিসেবে মার্কিন সৈন্যদের জন্য তথাকথিত সংবেদনশীলতার ট্রেনিংয়ের ব্যবস্থা করেন। তবে এগারো বছর পর এমন ব্যবস্থা এবং তার উপলব্ধি খানিকটা বিলম্বিত পদক্ষেপ নয়, জেনারেল? 
পূর্ববর্তী সময়েও মার্কিন সৈন্যরা এ রকম স্পর্শকাতরতা সম্বন্ধে অজ্ঞ ছিল না। সুতরাং এমন মামুলি বিষয়ে এখন আফগানিস্তানে অবস্থানরত মার্কিন সৈন্যরা অনবিহত থাকবে তা কেউ ভাবেনি। কিন্তু ক্রমবর্ধমান শক্তির দম্ভে এরাও বেসামাল হয়ে পড়েছে। আগেও যখন রুশদের বিরুদ্ধে ‘মুজাহিদিনদের যুদ্ধ হয় তখনো আফগানিস্তানে ছিল মুজাহিদিনদের পাশাপাশি একই মার্কিনিরা। তখনো তারা ধর্মের মতো স্পর্শকাতর ও গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে চাতুরির আশ্রয় নিয়েছে বা দায়সারা ক্ষমাপ্রার্থনা করেছে।
২০০৫ সালে আফগানিস্তান ক্রুদ্ধ প্রতিক্রিয়ায় ফেটে পড়ে যখন জানা যায় যে, গুয়ানতানামোর গোয়েন্দারা তাদের প্ররোচনার পন্থা হিসেবে কুরআনের অমর্যাদা করেছে। অতি সম্প্রতি যখন দোহার মার্কিনি ও তালেবানরা কোনো নিষ্পত্তির লক্ষ্যে আলোচনারত, তেমনই এক স্পর্শকাতর সময়ে ইয়াংকিদের আফগান মৃতদেহের ওপর মূত্রত্যাগের চিত্র প্রকাশিত হয়। ‘দ্য কোয়ালিশন অব উইলিং’-এর অন্তর্ভুক্ত অন্যদের নৈতিকতাবোধও কোনো উচ্চমানের ছিল না। তারাও সোৎসাহে আফগান বালকদের সাথে রতিক্রিয়া অবস্থায় আলোকচিত্রভুক্ত হচ্ছিল।
কোয়ালিশনের সবারই একই দাবি, তারা শুধু আফগানদের হৃদয়মন জয়ের মিশনে এমন একটি ছন্নছাড়া দেশে। অবশ্য তাদের হৃদয়মন জয়ের নমুনাও লক্ষণীয়। হয়তো তা বিয়ের আনন্দঘন অনুষ্ঠানে মৃত্যুদূতের মতো মারণাস্ত্রের উৎক্ষেপণ অথবা কোনো মৃতের সৎকারে সমবেত শোকার্তদের ওপর বোমাবর্ষণ। এভাবে হৃদয়মন জয়ের নামে মার্কিনিদের আফগান হত্যাও এক ধরনের কৌতুক। যদিও বা এই বাড়াবাড়িগুলো এড়ানো যেত, মার্কিনিরা ইচ্ছে করেই তা করেনি। তাদের উদ্দেশ্য যেকোনো ছুতোয় দোহার সমঝোতাকে ভেস্তে দেয়া। আফগানিস্তান ছাড়তে খোদ মার্কিন মুলুকেও অনেক সামরিক স্ট্যাবলিশমেন্ট আছে যারা এই যুদ্ধ শেষ হোক তা চায় না।
এই ‘গ্রেট গ্রেম’-এর সাথে সংশ্লিষ্ট বাজি অনেক আকর্ষণীয় বিধায় ওয়াশিংটনের এই স্ট্র্যাটেজিক অঞ্চল আঁকড়ে থাকার বাসনা প্রবল থেকে প্রবলতর হয়ে উঠছে। এ ছাড়া আফগানিস্তানের ভূগর্ভে যে পরিমাণ খনিজসম্পদ লুকায়িত আছে এবং যাতে এখনো হাতই দেয়া হয়নি তারও আকর্ষণ কম কিসে?
বিশ্লেষক পণ্ডিত বুচানান ওবামার কুরআনের মানহানির জন্য ক্ষমা প্রার্থনাকে অসন্তোষের সাথে দেখেছেন। একটি মতপ্রকাশের সুযোগ নিয়ে এই রক্ষণশীল রাজনৈতিক বিশ্লেষক ক্রুদ্ধ প্রতিক্রিয়াও ব্যক্ত করেছেন। তার উক্তিতে আমেরিকা বহু বিলিয়ন ডলার আফগানিস্তানে কিছু পেতেই ব্যয় করেছে, হাজার হাজার মার্কিনি প্রাণ দিয়েছে। প্রশ্ন না উঠে পারে না যে, এসব কিসের জন্য। তিনি এসবেরই একটি যৌক্তিকতা অবশ্য দেখিয়েছেন।
এক দিকে আফগানিস্তান আংকল স্যামকে একটি বিরল সুবিধাজনক অবস্থান দেয় যা একটি পুনরুত্থিত রাশিয়া ও চতুর চীনকে ঠেকিয়ে রাখতে অত্যন্ত মূলবান। অন্য দিকে অদম্য ইরান একটি ঝঞ্ঝাটে পাকিস্তান। ইতোমধ্যে বিশ্বের জ্বালানির বাটি উপসাগরেও রয়েছে আংকল স্যামের বিশাল উপস্থিতি। নয়-এগারো এগুলোর জন্য ছিল শুধু প্রদর্শিত কারণ। তারও চেয়ে বেশি বিশ্বকে হাতের মুঠোয় আনতে আমেরিকা বাহ্যত এই সুযোগগুলোর ব্যবহার করেছিল।
তার পরও এমন পরিকল্পনা এবং উচ্চাকাক্সা নিয়ে হিন্দুকুশে প্রবেশে আমেরিকা কিন্তু প্রথম ছিল না। এর আগেও ব্রিটিশরা এসেছিল তাদের গ্রেট গেমের গ্রান্ড স্ট্র্যাটেজি নিয়ে। আরো সম্প্রতি রুশরা এসেছিল। আরো এসেছিল গ্রিক থেকে শুরু করে মোঙ্গল পর্যন্ত বিভিন্ন জাতির অভিযাত্রীরা। ব্রিটিশরা মাত্র কয়েকটি ব্যর্থ অপমানকর প্রচেষ্টার পর আফগানিস্তান ছেড়েছিল। রুশদের আফগানিস্তান দখলের খেসারত দিতে হয়েছিল সোভিয়েত সাম্রাজ্য পতনের মধ্য দিয়ে।
সেনাবিপর্যয়ের মধ্য দিয়ে মার্কিনিরা আফগানিস্তানে এক যুগ পেরোনোর পর কী ভাবছে যে তারাই সফল হবে যেখানে অন্য সবাই ব্যর্থ হয়েছে? অথচ সবাই অর্থাৎ যারাই এ গ্রেট গেমে অংশ নিয়েছে সবাই কিন্তু এই দুঃসাহসিক প্রচেষ্টাকে একটি বিনিয়োগ ভেবেছিল। কিন্তু শেষ অবধি মূলধন হারানোর ভয়ে অন্যরা এখান থেকে গুটিয়ে নিলেও ‘ইচ্ছুকদের কোয়ালিশন’ এখনো যেভাবে ছড়িয়ে পড়ছে সেই নির্বুদ্ধিতায়ই তাদের ধ্বংস নিহিত। কিছু আগে হোক বা পরে হোক মার্কিনিদের যে বিতাড়িত হতেই হবে, তা এখন আর কোনো বিতর্কের বিষয় নয়। তাদের বিতাড়ন সুনিশ্চিত। যেটা এখন দেখার বিষয় তা হলো কিভাবে তারা যাবে? ব্রিটিশরা কোনোমতে পালিয়ে বেঁচেছিল। রুশরা শুধু ক্ষতবিক্ষত হয়েই ফেরেনি, ফেরার পর তারা স্বচক্ষে দেখেছে তাদের চার দিকে তাদের সাম্রাজ্য টুকরো টুকরো হয়ে ভেঙে পড়তে। 

লেখক : অবসরপ্রাপ্ত ব্রিগেডিয়ার এবং নিরাপত্তা, রাজনীতি, বৈদেশিক নীতি ও আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিশ্লেষক

শুক্রবার, ৪ মে, ২০১২

নির্বাচিত স্বৈরশাসকরা


এম আবদুল হাফিজ
বাংলাদেশের রাজনীতিতে সামরিক স্বৈরশাসকদের সঙ্গে আমরা কমবেশি পরিচিত। ১৯৭৫-এর ১৫ আগস্টের পথ ধরেই এ দেশে স্বৈরশাসনের সূচনা, যদিও বাকশালী একদলীয় শাসনের প্রবর্তনই তার প্রারম্ভিক পদক্ষেপ। সামগ্রিক বিচারে স্বাধীনতার উষালগ্ন থেকেই আমরা কর্তৃত্ববাদী শাসনের ফাঁদে ফেঁসে যাই। সমগ্র মুক্তিসংগ্রামের মূলমন্ত্র গণতন্ত্রকে শাসন শকটের পেছনের আসনে ঠেলে দেওয়া হয় এবং চালকের আসনটি দখল করে কর্তৃত্ববাদ ও স্বেচ্ছাচার। স্বাধীনতার সুদীর্ঘ সংগ্রামে আপামর জনগণের গণতন্ত্রে দীক্ষা কর্তৃত্ববাদকে গণতন্ত্রের মুখোমুখি এক সাংঘর্ষিক অবস্থানে দাঁড় করায়। অতঃপর কোনো না কোনো আঙ্গিকে এই সংঘর্ষের প্রকাশ ঘটেছে। আরও অনেক বছর পরে যখন ১৫ আগস্ট ট্র্যাজেডির চুলচেরা বিশ্লেষণ হবে, আমরা না হোক, আমাদের ভবিষ্যৎ প্রজন্ম গণতন্ত্র বনাম স্বৈরতন্ত্রের সংঘাত সম্বন্ধে অনেক কিছু জানবে।
আজ লিখতে বসেছি প্রচণ্ড জনপ্রিয় এবং বিপুলভাবে নির্বাচিত স্বৈরশাসকদের নিয়ে, যাদের নাগপাশ থেকে বেরিয়ে আসা যায় না। কেননা তারা নির্বাচিত জনপ্রতিনিধি, সামরিক স্বৈরশাসকদের মতো অবৈধভাবে ক্ষমতা দখলকারী নয়। তারা অন্তহীন স্বেচ্ছাচার করলেও তাদের বিরুদ্ধাচরণ করা যায় না। করলে তা গণতন্ত্রবিরোধিতা বলেই পরিগণিত হয়। তাদের বিরুদ্ধে আন্দোলন করলে তা নির্বাচিত সরকার উৎখাতের আন্দোলন বলে পরিগণিত হয় এবং সচেতন সমাজের প্রখর সমালোচনার মুখে পড়তে হয়।
আমাদের সর্বশেষ সামরিক স্বৈরশাসক এরশাদের বিরুদ্ধে আমরা দলমত নির্বিশেষে এক যুগ ধরে আন্দোলন করেছিলাম। সেই সময়ই সম্ভবত খালেদা-হাসিনা পরোক্ষ বা প্রত্যক্ষভাবে পরস্পরের সবচেয়ে নিকটবর্তী হয়েছিলেন। এরশাদবিরোধী আন্দোলনে একটি সর্বজনীনতা ছিল। যেহেতু তিনি সামরিক স্বৈরশাসক এবং তার লুটপাট ও চারিত্রিক বিকৃতিও কম ছিল না, তাই এক যুগের আন্দোলনেও কদাচিৎ তাতে ভাটা পড়েছে। বরং সে আন্দোলন প্রলম্বিত হলেও জমেছিল বেশ।
এরশাদের পতনের পরই আমরা উপলব্ধি করলাম যে, তার পতন কিন্তু স্বৈরাচারের সমাপ্তি ঘটায়নি। এখনও তা আরও তীব্রভাবে বলবৎ আছে। স্বৈরাচারের উপসর্গ গুলি-নির্যাতন, দুর্নীতি-অনিয়ম, জনমতের বিরুদ্ধাচরণ ইত্যাদি এখনও বহাল-তবিয়তে। কিন্তু সেগুলোর বিরুদ্ধে আর আগের মতো আন্দোলন গড়ে তোলা যায় না। তা করতে গেলেই গণতন্ত্রের বিরুদ্ধাচারীরূপে শনাক্ত হতে হয়। গণতন্ত্র বিপদগ্রস্ত জিগির তোলা হয়। গণতন্ত্রের মন্ত্রে সেই প্রাক-স্বাধীনতা আমল থেকেই দীক্ষিত এ দেশের মানুষ গণতন্ত্রের প্রতি অত্যন্ত দুর্বল। গণতন্ত্রের জন্য এ দেশে নূর হোসেনের মতো জেনেশুনে মৃত্যুকে আলিঙ্গন করার মতো তরুণ বৈতালিকের অভাব নেই। তাই গণতন্ত্রের নামে স্বৈরাচারের চর্চাকারীরা সহজেই পার পেয়ে যায়।
১৯৯১-এর পর এ দেশে যে ক'টি এবং যে দলেরই শাসন প্রতিষ্ঠিত হয়েছে তাদের সবাই কমবেশি স্বৈরাচারী ছিল, অন্তত তাদের আচার-আচরণে। দেখাই যাক একবার নিকট অতীতের চারদলীয় জোট এবং চলমান মহাজোট সরকারের শাসনশৈলী। বিএনপি নেতৃত্বাধীন চারদলীয় জোট একটি অযোগ্য সরকার হওয়া সত্ত্বেও অত্যন্ত ঔদ্ধত্যপূর্ণ ছিল। সরকারের জ্ঞাত বা অজ্ঞাতসারে ওই সময় জঙ্গিবাদের উত্থান হয়েছিল। দ্রব্যমূল্যে নিয়ন্ত্রণহীনতা ছাড়াও ওই সময়ই বিদ্যুৎ-জ্বালানি সংকট প্রকট হয়েছিল। একটি কোণঠাসা বিরোধী দল আওয়ামী লীগ তখন জোট সরকার উৎখাতে সর্বশক্তি নিয়োগ করেছিল। এখনকার ফখরুল ইসলাম আলমগীর সাহেবের মতো আওয়ামী লীগের আবদুল জলিল তখনও সরকার পতনের আলটিমেটাম দিয়েছিলেন। রাজধানী তখন প্রকৃতপক্ষে রণাঙ্গনে পরিণত হয়েছিল। শেষ পর্যন্ত এক অনাকাঙ্ক্ষিত এক-এগারোয় তার পরিণতি ঘটেছিল; কিন্তু জোট সরকারের পতন হয়নি। এর কারণ সম্ভবত একটাই। যতই অগণতান্ত্রিক এবং স্বেচ্ছাচারীই হোক না কেন জোট সরকার জনগণের ম্যান্ডেটপ্রাপ্ত একটি নির্বাচিত সরকার ছিল। ওই একই বাস্তবতার পুনরাবৃত্তি হচ্ছে এখন। বিএনপি নেতৃত্বাধীন ১৮ দলীয় জোট যতই চেষ্টা করুক না কেন মহাজোট সরকারের পতন একই কারণে ঘটাতে পারবে না। তবে হ্যাঁ, মহাজোটকে হয়তো খানিকটা বিক্ষত-বিপর্যস্ত করা অসম্ভব নয়, কিন্তু মহাজোটের পতন ঘটানো অসম্ভব। কেননা মহাজোট সরকার তো জনগণের ম্যান্ডেটপ্রাপ্ত একটি নির্বাচিত সরকার। তার মেয়াদকালে এই সরকার টিকে থাকবে। জনগণ যতই সরকারের বিরুদ্ধে রুষ্ট থাকুক না কেন তারা এটুকু বোঝে যে, সরকার পতনের ঐতিহ্য শেষ পর্যন্ত কোনো ভালো ঐতিহ্য নয়। তবু সান্ত্বনা এটাই যে, এই স্বৈরশাসকদের মেয়াদ উত্তীর্ণের পর বিনা আন্দোলনেই কেটে পড়তে হয় গণতন্ত্রেরই বদৌলতে।

ব্রিগেডিয়ার (অব.) এম আবদুল হাফিজ :সাবেক মহাপরিচালক বিআইআইএসএস ও কলাম লেখক