॥ এম. আবদুল হাফিজ ॥
আমেরিকানেরা সত্যিই কি এত নির্বোধ! এত দীর্ঘ সময় বিশ্বের সর্বাধিক বিপজ্জনক রণক্ষেত্রে কাটিয়ে এবং তীব্রভাবে গঠিত ও উগ্র স্বভাবসম্পন্ন আফগানদের সংস্পর্শে থেকেও তাদের সাথে লেনদেনের ব্যাপারে কি অবলীলায় প্রলাপোক্তি করে যায়, যা আমরা সম্প্রতিই দেখলাম। পশ্চিমাদের জন্য উপলব্ধি করা কেন এত কঠিন যে বিশ্বাস মানুষের বিশেষ করে মুসলমান ধর্মাবলম্বীদের জীবনে এত কেন্দ্রীয় ভূমিকা পালন করে। যে-কেউ মুসলমানদের তাদের পবিত্র গ্রন্থ কুরআন বহন করতে দেখেছে, অন্তত তাদের এ কথা জানা উচিত। তারা কুরআনকে অত্যন্ত সম্মানের সাথে ধারণ করে এবং যখন তারা অপবিত্র অবস্থায় থাকে, তারা তা স্পর্শও করে না। যখন নিজেদের বিশ্বাসের জন্য সম্মান ও ভালোবাসার প্রশ্ন, আফগানদের চেয়ে কদাচিত অন্য কোনো মুসলমান তা তাদের মতো নিখুঁতভাবে করতে পারে।
গত বছর যখন ডেনমার্কে কুরআন নিয়ে হিংসাপ্রসূত ব্যঙ্গাত্মক তৎপরতা মুসলমানেরা জ্ঞাত হয়, এর সবচেয়ে স্বতঃস্ফূর্ত এবং প্রচণ্ড প্রতিবাদটি হয়েছিল আফগানিস্তানে। সেখানে ক্রোধ ছড়িয়ে পড়ায় অনেকে হতাহতও হয়েছিল। ইতিহাসের পুনরাবৃত্তি হতেই থাকে। সুদূর ফোরিডায় একজন প্রচারপ্রিয় পাদ্রি ঘোষণা দেয় যে, সে ইসলামের ধর্মপুস্তকগুলো পোড়ানোর উৎসব করবে। আফগানেরা শুধু এমন ঘোষণায়ও ক্রুদ্ধ প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করেছিল। আফগানরা কিন্তু এমন প্ররোচনাকে চ্যালেঞ্জ না করে ছাড়ে না। পশতুনওয়ালি ঐতিহ্য তাদের ধমনীতে। ন্যায়ের জন্য তারা মারতে ও মরতে জানে। দেশটিও বৈশিষ্ট্যগতভাবে সাম্রাজ্যের সমাধি বলে পরিচিত।
এই আফগানিস্তানে এক যুগের অধিক সময় কাটিয়েও এখানে প্রায় পাঁচ শ’ বিলিয়ন ডলার ব্যয় করে। এমন তো হওয়ার কথা নয় যে ইয়াংকিরা দেশটি ও তার জনগণের প্রকৃতি এখনো উপলব্ধি করেনি। তাদের বাগরাম বিমানঘাঁটিতে কুরআন পুড়িয়ে ফেলার সাহসকে কি বলা যাবে? নির্বুদ্ধিতা? অনুভূতিহীনতা? অথবা দুটোই? এতে প্রত্যাশিতভাবে কয়েক দিন ধরে মার্কিনিদের গণহারে হত্যাÑ তাও আবার নিরাপদ বিবেচিত স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে তাদের? আফগান সহকর্মীদের হাতে।
অবশেষে প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামা একটি মৃদু কাশি দেয়ার মতো করে একটি ‘ক্ষমা প্রার্থনা’ বা ‘স্যরি’ উচ্চারণ করেন। আফগানিস্তানে তার সামরিক কমান্ডার জেনারেল অ্যালেনও অনুরূপ একটি ‘স্যরি’র ভান করলেন। অ্যালেন অবশ্য সতর্কতামূলক একটি পদক্ষেপ হিসেবে মার্কিন সৈন্যদের জন্য তথাকথিত সংবেদনশীলতার ট্রেনিংয়ের ব্যবস্থা করেন। তবে এগারো বছর পর এমন ব্যবস্থা এবং তার উপলব্ধি খানিকটা বিলম্বিত পদক্ষেপ নয়, জেনারেল?
পূর্ববর্তী সময়েও মার্কিন সৈন্যরা এ রকম স্পর্শকাতরতা সম্বন্ধে অজ্ঞ ছিল না। সুতরাং এমন মামুলি বিষয়ে এখন আফগানিস্তানে অবস্থানরত মার্কিন সৈন্যরা অনবিহত থাকবে তা কেউ ভাবেনি। কিন্তু ক্রমবর্ধমান শক্তির দম্ভে এরাও বেসামাল হয়ে পড়েছে। আগেও যখন রুশদের বিরুদ্ধে ‘মুজাহিদিনদের যুদ্ধ হয় তখনো আফগানিস্তানে ছিল মুজাহিদিনদের পাশাপাশি একই মার্কিনিরা। তখনো তারা ধর্মের মতো স্পর্শকাতর ও গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে চাতুরির আশ্রয় নিয়েছে বা দায়সারা ক্ষমাপ্রার্থনা করেছে।
২০০৫ সালে আফগানিস্তান ক্রুদ্ধ প্রতিক্রিয়ায় ফেটে পড়ে যখন জানা যায় যে, গুয়ানতানামোর গোয়েন্দারা তাদের প্ররোচনার পন্থা হিসেবে কুরআনের অমর্যাদা করেছে। অতি সম্প্রতি যখন দোহার মার্কিনি ও তালেবানরা কোনো নিষ্পত্তির লক্ষ্যে আলোচনারত, তেমনই এক স্পর্শকাতর সময়ে ইয়াংকিদের আফগান মৃতদেহের ওপর মূত্রত্যাগের চিত্র প্রকাশিত হয়। ‘দ্য কোয়ালিশন অব উইলিং’-এর অন্তর্ভুক্ত অন্যদের নৈতিকতাবোধও কোনো উচ্চমানের ছিল না। তারাও সোৎসাহে আফগান বালকদের সাথে রতিক্রিয়া অবস্থায় আলোকচিত্রভুক্ত হচ্ছিল।
কোয়ালিশনের সবারই একই দাবি, তারা শুধু আফগানদের হৃদয়মন জয়ের মিশনে এমন একটি ছন্নছাড়া দেশে। অবশ্য তাদের হৃদয়মন জয়ের নমুনাও লক্ষণীয়। হয়তো তা বিয়ের আনন্দঘন অনুষ্ঠানে মৃত্যুদূতের মতো মারণাস্ত্রের উৎক্ষেপণ অথবা কোনো মৃতের সৎকারে সমবেত শোকার্তদের ওপর বোমাবর্ষণ। এভাবে হৃদয়মন জয়ের নামে মার্কিনিদের আফগান হত্যাও এক ধরনের কৌতুক। যদিও বা এই বাড়াবাড়িগুলো এড়ানো যেত, মার্কিনিরা ইচ্ছে করেই তা করেনি। তাদের উদ্দেশ্য যেকোনো ছুতোয় দোহার সমঝোতাকে ভেস্তে দেয়া। আফগানিস্তান ছাড়তে খোদ মার্কিন মুলুকেও অনেক সামরিক স্ট্যাবলিশমেন্ট আছে যারা এই যুদ্ধ শেষ হোক তা চায় না।
এই ‘গ্রেট গ্রেম’-এর সাথে সংশ্লিষ্ট বাজি অনেক আকর্ষণীয় বিধায় ওয়াশিংটনের এই স্ট্র্যাটেজিক অঞ্চল আঁকড়ে থাকার বাসনা প্রবল থেকে প্রবলতর হয়ে উঠছে। এ ছাড়া আফগানিস্তানের ভূগর্ভে যে পরিমাণ খনিজসম্পদ লুকায়িত আছে এবং যাতে এখনো হাতই দেয়া হয়নি তারও আকর্ষণ কম কিসে?
বিশ্লেষক পণ্ডিত বুচানান ওবামার কুরআনের মানহানির জন্য ক্ষমা প্রার্থনাকে অসন্তোষের সাথে দেখেছেন। একটি মতপ্রকাশের সুযোগ নিয়ে এই রক্ষণশীল রাজনৈতিক বিশ্লেষক ক্রুদ্ধ প্রতিক্রিয়াও ব্যক্ত করেছেন। তার উক্তিতে আমেরিকা বহু বিলিয়ন ডলার আফগানিস্তানে কিছু পেতেই ব্যয় করেছে, হাজার হাজার মার্কিনি প্রাণ দিয়েছে। প্রশ্ন না উঠে পারে না যে, এসব কিসের জন্য। তিনি এসবেরই একটি যৌক্তিকতা অবশ্য দেখিয়েছেন।
এক দিকে আফগানিস্তান আংকল স্যামকে একটি বিরল সুবিধাজনক অবস্থান দেয় যা একটি পুনরুত্থিত রাশিয়া ও চতুর চীনকে ঠেকিয়ে রাখতে অত্যন্ত মূলবান। অন্য দিকে অদম্য ইরান একটি ঝঞ্ঝাটে পাকিস্তান। ইতোমধ্যে বিশ্বের জ্বালানির বাটি উপসাগরেও রয়েছে আংকল স্যামের বিশাল উপস্থিতি। নয়-এগারো এগুলোর জন্য ছিল শুধু প্রদর্শিত কারণ। তারও চেয়ে বেশি বিশ্বকে হাতের মুঠোয় আনতে আমেরিকা বাহ্যত এই সুযোগগুলোর ব্যবহার করেছিল।
তার পরও এমন পরিকল্পনা এবং উচ্চাকাক্সা নিয়ে হিন্দুকুশে প্রবেশে আমেরিকা কিন্তু প্রথম ছিল না। এর আগেও ব্রিটিশরা এসেছিল তাদের গ্রেট গেমের গ্রান্ড স্ট্র্যাটেজি নিয়ে। আরো সম্প্রতি রুশরা এসেছিল। আরো এসেছিল গ্রিক থেকে শুরু করে মোঙ্গল পর্যন্ত বিভিন্ন জাতির অভিযাত্রীরা। ব্রিটিশরা মাত্র কয়েকটি ব্যর্থ অপমানকর প্রচেষ্টার পর আফগানিস্তান ছেড়েছিল। রুশদের আফগানিস্তান দখলের খেসারত দিতে হয়েছিল সোভিয়েত সাম্রাজ্য পতনের মধ্য দিয়ে।
সেনাবিপর্যয়ের মধ্য দিয়ে মার্কিনিরা আফগানিস্তানে এক যুগ পেরোনোর পর কী ভাবছে যে তারাই সফল হবে যেখানে অন্য সবাই ব্যর্থ হয়েছে? অথচ সবাই অর্থাৎ যারাই এ গ্রেট গেমে অংশ নিয়েছে সবাই কিন্তু এই দুঃসাহসিক প্রচেষ্টাকে একটি বিনিয়োগ ভেবেছিল। কিন্তু শেষ অবধি মূলধন হারানোর ভয়ে অন্যরা এখান থেকে গুটিয়ে নিলেও ‘ইচ্ছুকদের কোয়ালিশন’ এখনো যেভাবে ছড়িয়ে পড়ছে সেই নির্বুদ্ধিতায়ই তাদের ধ্বংস নিহিত। কিছু আগে হোক বা পরে হোক মার্কিনিদের যে বিতাড়িত হতেই হবে, তা এখন আর কোনো বিতর্কের বিষয় নয়। তাদের বিতাড়ন সুনিশ্চিত। যেটা এখন দেখার বিষয় তা হলো কিভাবে তারা যাবে? ব্রিটিশরা কোনোমতে পালিয়ে বেঁচেছিল। রুশরা শুধু ক্ষতবিক্ষত হয়েই ফেরেনি, ফেরার পর তারা স্বচক্ষে দেখেছে তাদের চার দিকে তাদের সাম্রাজ্য টুকরো টুকরো হয়ে ভেঙে পড়তে।
লেখক : অবসরপ্রাপ্ত ব্রিগেডিয়ার এবং নিরাপত্তা, রাজনীতি, বৈদেশিক নীতি ও আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিশ্লেষক
আমেরিকানেরা সত্যিই কি এত নির্বোধ! এত দীর্ঘ সময় বিশ্বের সর্বাধিক বিপজ্জনক রণক্ষেত্রে কাটিয়ে এবং তীব্রভাবে গঠিত ও উগ্র স্বভাবসম্পন্ন আফগানদের সংস্পর্শে থেকেও তাদের সাথে লেনদেনের ব্যাপারে কি অবলীলায় প্রলাপোক্তি করে যায়, যা আমরা সম্প্রতিই দেখলাম। পশ্চিমাদের জন্য উপলব্ধি করা কেন এত কঠিন যে বিশ্বাস মানুষের বিশেষ করে মুসলমান ধর্মাবলম্বীদের জীবনে এত কেন্দ্রীয় ভূমিকা পালন করে। যে-কেউ মুসলমানদের তাদের পবিত্র গ্রন্থ কুরআন বহন করতে দেখেছে, অন্তত তাদের এ কথা জানা উচিত। তারা কুরআনকে অত্যন্ত সম্মানের সাথে ধারণ করে এবং যখন তারা অপবিত্র অবস্থায় থাকে, তারা তা স্পর্শও করে না। যখন নিজেদের বিশ্বাসের জন্য সম্মান ও ভালোবাসার প্রশ্ন, আফগানদের চেয়ে কদাচিত অন্য কোনো মুসলমান তা তাদের মতো নিখুঁতভাবে করতে পারে।
গত বছর যখন ডেনমার্কে কুরআন নিয়ে হিংসাপ্রসূত ব্যঙ্গাত্মক তৎপরতা মুসলমানেরা জ্ঞাত হয়, এর সবচেয়ে স্বতঃস্ফূর্ত এবং প্রচণ্ড প্রতিবাদটি হয়েছিল আফগানিস্তানে। সেখানে ক্রোধ ছড়িয়ে পড়ায় অনেকে হতাহতও হয়েছিল। ইতিহাসের পুনরাবৃত্তি হতেই থাকে। সুদূর ফোরিডায় একজন প্রচারপ্রিয় পাদ্রি ঘোষণা দেয় যে, সে ইসলামের ধর্মপুস্তকগুলো পোড়ানোর উৎসব করবে। আফগানেরা শুধু এমন ঘোষণায়ও ক্রুদ্ধ প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করেছিল। আফগানরা কিন্তু এমন প্ররোচনাকে চ্যালেঞ্জ না করে ছাড়ে না। পশতুনওয়ালি ঐতিহ্য তাদের ধমনীতে। ন্যায়ের জন্য তারা মারতে ও মরতে জানে। দেশটিও বৈশিষ্ট্যগতভাবে সাম্রাজ্যের সমাধি বলে পরিচিত।
এই আফগানিস্তানে এক যুগের অধিক সময় কাটিয়েও এখানে প্রায় পাঁচ শ’ বিলিয়ন ডলার ব্যয় করে। এমন তো হওয়ার কথা নয় যে ইয়াংকিরা দেশটি ও তার জনগণের প্রকৃতি এখনো উপলব্ধি করেনি। তাদের বাগরাম বিমানঘাঁটিতে কুরআন পুড়িয়ে ফেলার সাহসকে কি বলা যাবে? নির্বুদ্ধিতা? অনুভূতিহীনতা? অথবা দুটোই? এতে প্রত্যাশিতভাবে কয়েক দিন ধরে মার্কিনিদের গণহারে হত্যাÑ তাও আবার নিরাপদ বিবেচিত স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে তাদের? আফগান সহকর্মীদের হাতে।
অবশেষে প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামা একটি মৃদু কাশি দেয়ার মতো করে একটি ‘ক্ষমা প্রার্থনা’ বা ‘স্যরি’ উচ্চারণ করেন। আফগানিস্তানে তার সামরিক কমান্ডার জেনারেল অ্যালেনও অনুরূপ একটি ‘স্যরি’র ভান করলেন। অ্যালেন অবশ্য সতর্কতামূলক একটি পদক্ষেপ হিসেবে মার্কিন সৈন্যদের জন্য তথাকথিত সংবেদনশীলতার ট্রেনিংয়ের ব্যবস্থা করেন। তবে এগারো বছর পর এমন ব্যবস্থা এবং তার উপলব্ধি খানিকটা বিলম্বিত পদক্ষেপ নয়, জেনারেল?
পূর্ববর্তী সময়েও মার্কিন সৈন্যরা এ রকম স্পর্শকাতরতা সম্বন্ধে অজ্ঞ ছিল না। সুতরাং এমন মামুলি বিষয়ে এখন আফগানিস্তানে অবস্থানরত মার্কিন সৈন্যরা অনবিহত থাকবে তা কেউ ভাবেনি। কিন্তু ক্রমবর্ধমান শক্তির দম্ভে এরাও বেসামাল হয়ে পড়েছে। আগেও যখন রুশদের বিরুদ্ধে ‘মুজাহিদিনদের যুদ্ধ হয় তখনো আফগানিস্তানে ছিল মুজাহিদিনদের পাশাপাশি একই মার্কিনিরা। তখনো তারা ধর্মের মতো স্পর্শকাতর ও গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে চাতুরির আশ্রয় নিয়েছে বা দায়সারা ক্ষমাপ্রার্থনা করেছে।
২০০৫ সালে আফগানিস্তান ক্রুদ্ধ প্রতিক্রিয়ায় ফেটে পড়ে যখন জানা যায় যে, গুয়ানতানামোর গোয়েন্দারা তাদের প্ররোচনার পন্থা হিসেবে কুরআনের অমর্যাদা করেছে। অতি সম্প্রতি যখন দোহার মার্কিনি ও তালেবানরা কোনো নিষ্পত্তির লক্ষ্যে আলোচনারত, তেমনই এক স্পর্শকাতর সময়ে ইয়াংকিদের আফগান মৃতদেহের ওপর মূত্রত্যাগের চিত্র প্রকাশিত হয়। ‘দ্য কোয়ালিশন অব উইলিং’-এর অন্তর্ভুক্ত অন্যদের নৈতিকতাবোধও কোনো উচ্চমানের ছিল না। তারাও সোৎসাহে আফগান বালকদের সাথে রতিক্রিয়া অবস্থায় আলোকচিত্রভুক্ত হচ্ছিল।
কোয়ালিশনের সবারই একই দাবি, তারা শুধু আফগানদের হৃদয়মন জয়ের মিশনে এমন একটি ছন্নছাড়া দেশে। অবশ্য তাদের হৃদয়মন জয়ের নমুনাও লক্ষণীয়। হয়তো তা বিয়ের আনন্দঘন অনুষ্ঠানে মৃত্যুদূতের মতো মারণাস্ত্রের উৎক্ষেপণ অথবা কোনো মৃতের সৎকারে সমবেত শোকার্তদের ওপর বোমাবর্ষণ। এভাবে হৃদয়মন জয়ের নামে মার্কিনিদের আফগান হত্যাও এক ধরনের কৌতুক। যদিও বা এই বাড়াবাড়িগুলো এড়ানো যেত, মার্কিনিরা ইচ্ছে করেই তা করেনি। তাদের উদ্দেশ্য যেকোনো ছুতোয় দোহার সমঝোতাকে ভেস্তে দেয়া। আফগানিস্তান ছাড়তে খোদ মার্কিন মুলুকেও অনেক সামরিক স্ট্যাবলিশমেন্ট আছে যারা এই যুদ্ধ শেষ হোক তা চায় না।
এই ‘গ্রেট গ্রেম’-এর সাথে সংশ্লিষ্ট বাজি অনেক আকর্ষণীয় বিধায় ওয়াশিংটনের এই স্ট্র্যাটেজিক অঞ্চল আঁকড়ে থাকার বাসনা প্রবল থেকে প্রবলতর হয়ে উঠছে। এ ছাড়া আফগানিস্তানের ভূগর্ভে যে পরিমাণ খনিজসম্পদ লুকায়িত আছে এবং যাতে এখনো হাতই দেয়া হয়নি তারও আকর্ষণ কম কিসে?
বিশ্লেষক পণ্ডিত বুচানান ওবামার কুরআনের মানহানির জন্য ক্ষমা প্রার্থনাকে অসন্তোষের সাথে দেখেছেন। একটি মতপ্রকাশের সুযোগ নিয়ে এই রক্ষণশীল রাজনৈতিক বিশ্লেষক ক্রুদ্ধ প্রতিক্রিয়াও ব্যক্ত করেছেন। তার উক্তিতে আমেরিকা বহু বিলিয়ন ডলার আফগানিস্তানে কিছু পেতেই ব্যয় করেছে, হাজার হাজার মার্কিনি প্রাণ দিয়েছে। প্রশ্ন না উঠে পারে না যে, এসব কিসের জন্য। তিনি এসবেরই একটি যৌক্তিকতা অবশ্য দেখিয়েছেন।
এক দিকে আফগানিস্তান আংকল স্যামকে একটি বিরল সুবিধাজনক অবস্থান দেয় যা একটি পুনরুত্থিত রাশিয়া ও চতুর চীনকে ঠেকিয়ে রাখতে অত্যন্ত মূলবান। অন্য দিকে অদম্য ইরান একটি ঝঞ্ঝাটে পাকিস্তান। ইতোমধ্যে বিশ্বের জ্বালানির বাটি উপসাগরেও রয়েছে আংকল স্যামের বিশাল উপস্থিতি। নয়-এগারো এগুলোর জন্য ছিল শুধু প্রদর্শিত কারণ। তারও চেয়ে বেশি বিশ্বকে হাতের মুঠোয় আনতে আমেরিকা বাহ্যত এই সুযোগগুলোর ব্যবহার করেছিল।
তার পরও এমন পরিকল্পনা এবং উচ্চাকাক্সা নিয়ে হিন্দুকুশে প্রবেশে আমেরিকা কিন্তু প্রথম ছিল না। এর আগেও ব্রিটিশরা এসেছিল তাদের গ্রেট গেমের গ্রান্ড স্ট্র্যাটেজি নিয়ে। আরো সম্প্রতি রুশরা এসেছিল। আরো এসেছিল গ্রিক থেকে শুরু করে মোঙ্গল পর্যন্ত বিভিন্ন জাতির অভিযাত্রীরা। ব্রিটিশরা মাত্র কয়েকটি ব্যর্থ অপমানকর প্রচেষ্টার পর আফগানিস্তান ছেড়েছিল। রুশদের আফগানিস্তান দখলের খেসারত দিতে হয়েছিল সোভিয়েত সাম্রাজ্য পতনের মধ্য দিয়ে।
সেনাবিপর্যয়ের মধ্য দিয়ে মার্কিনিরা আফগানিস্তানে এক যুগ পেরোনোর পর কী ভাবছে যে তারাই সফল হবে যেখানে অন্য সবাই ব্যর্থ হয়েছে? অথচ সবাই অর্থাৎ যারাই এ গ্রেট গেমে অংশ নিয়েছে সবাই কিন্তু এই দুঃসাহসিক প্রচেষ্টাকে একটি বিনিয়োগ ভেবেছিল। কিন্তু শেষ অবধি মূলধন হারানোর ভয়ে অন্যরা এখান থেকে গুটিয়ে নিলেও ‘ইচ্ছুকদের কোয়ালিশন’ এখনো যেভাবে ছড়িয়ে পড়ছে সেই নির্বুদ্ধিতায়ই তাদের ধ্বংস নিহিত। কিছু আগে হোক বা পরে হোক মার্কিনিদের যে বিতাড়িত হতেই হবে, তা এখন আর কোনো বিতর্কের বিষয় নয়। তাদের বিতাড়ন সুনিশ্চিত। যেটা এখন দেখার বিষয় তা হলো কিভাবে তারা যাবে? ব্রিটিশরা কোনোমতে পালিয়ে বেঁচেছিল। রুশরা শুধু ক্ষতবিক্ষত হয়েই ফেরেনি, ফেরার পর তারা স্বচক্ষে দেখেছে তাদের চার দিকে তাদের সাম্রাজ্য টুকরো টুকরো হয়ে ভেঙে পড়তে।
লেখক : অবসরপ্রাপ্ত ব্রিগেডিয়ার এবং নিরাপত্তা, রাজনীতি, বৈদেশিক নীতি ও আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিশ্লেষক
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন