বুধবার, ১৬ মে, ২০১২

দুঃসময়ের বন্দনাবিলাস


॥ এম. আবদুল হাফিজ ॥


নেতৃস্থানীয় যে কেউÑ তা সে রাজনৈতিক, শিক্ষা অথবা সংস্কৃতি অঙ্গনেই হোকÑ তার জন্য চাই হলভর্তি অথবা মাঠজুড়ে দর্শক শ্রোতার উপস্থিতি। শুধু উপস্থিতি নয় তাদের আবার হতে হবে বিশিষ্ট ও গুণীজন। শুধু তাহলেই নেতৃস্থানীয়দের ম্যাগনাম অপোসগুলোর সৃষ্টি সম্ভব। বন্দনাবিশারদ স্তাবকেরা সেই সৃষ্টি সম্ভব করতে প্রাণান্তকর চেষ্টা করেন। সমুদ্র জয়ের জন্য প্রধানমন্ত্রীকে নাগরিক সংবর্ধনা দেয়ার অনুষ্ঠানটি আপনারা অনেকে উপভোগ করে থাকবেন। আমাদের মতো সাধারণ্যের অবশ্য ওই সব এলিট অনুষ্ঠানে কদাচিত প্রবেশাধিকার ঘটে। তবু টেলিভিশনের বদৌলতে আমরাও দেশরতেœর অমৃতবাণী শ্রবণের সৌভাগ্য অর্জন করি কখনো কখনো।
আমাদের প্রধানমন্ত্রীর এ সব সংবর্ধনা গ্রহণেরও প্রচুর ধৈর্য ও স্ট্যামিনা রয়েছে। তার সব অর্জনের পেছনে তার পরিবারগত অবদান ও পিতার শিক্ষা কতটা কাজ করে সে সব তিনি এত সুন্দর করে গুছিয়ে বলতে পারেন। তা ছাড়া একটি অস্থিতিশীল দেশের অস্থিরতা ও উত্তেজনার মধ্যে তিনি আদৌ এই অনুষ্ঠানগুলোতে পৌরহীত্য যে করতে পারেন তা-ও তার প্রতিভারই স্বাক্ষর। একটি আন্দোলন হরতাল বিধ্বস্ত দেশেও তিনি এত কিছুর শীর্ষে থাকতে পারেন তা-ও এক বিস্ময়। অবশ্য নিন্দুকেরা বলে সে ক্ষমতার মোহ তাকে অনেক অসাধ্য সাধনে সাহায্য করে। আর পেছনে তো রয়েছেই তার স্তাবকের বহর যারা নিরন্তর তাকে প্রেরণা দিতে থাকে। তবে আমার মতো আবেগাপ্লুত মানুষের কাছে তার এত কিছুতে জড়িয়ে থাকা কিছুটা ক্রুরই লাগে।
এ সব মতলববাজিতে কি সত্যিই ক্ষমতার মেয়াদকে প্রলম্বিত করা যায় বা ক্ষমতা কুক্ষীগত করা যায়? অনেকেই সে চেষ্টা করতে কসুর করেননি। কিন্তু শেষরক্ষা হয়নি। এই নাতিদীর্ঘ জীবনে তো রাজনীতির খেলা কম দেখলাম না। আইয়ুব খাঁ যখন সাড়ম্বরে তার শাসনের অর্জন একটি ডিকেড অব প্রগ্রেস উদযাপনে লিপ্ত হলেন, তারই অতিপ্রিয় এবং বিশ্বাসী একজন জুলফিকার আলী ভুট্টো তাসখন্দ চুক্তিকে কেন্দ্র করে আইয়ুব খাঁর মুখোমুখি হলেনÑ এবার একজন প্রতিপক্ষের ভূমিকায়। শেষচেষ্টা করেও আইয়ুব খাঁর আর বৈরী রাজনৈতিক ঝড়ে আর মেরুদণ্ড সোজা করে দাঁড়াতে পারেননি।
একজন রেজাশাহ পাহলভি। ইরানে তার ক্ষমতার সূর্য যখন মধ্যাহ্ন গগনে কুলমান সচেতন এই নরপতি তার রাজবংশের পাঁচ হাজার বছর পূর্তিতে প্রাচীন রাজধানী পার্সিপলিসে তাবৎ পৃথিবীর রাজন্যদের জমায়েত করতে এক ধ্বংসাবশেষের ওপরই তৈরি করেছিলেন এক চোখধাঁধানো প্রাচীন রাজধানী। দাম্ভিক এই নরপতি পারস্যের জন্য অনেক বেশি বড় ছিলেন বলে মনে করতেন। মার্কিন স্বার্থের আনুকূল্যে তিনি পারস্যকে একটি আঞ্চলিক শক্তিতে পরিণত করতে চেয়েছিলেন, যা হবে মার্কিন আনুকূল্যে পরমাণু অস্ত্রসজ্জিত একটি দেশ যা ওই সময়ে উপসাগরীয় অঞ্চলের পুলিশম্যান বলে স্বীকৃতিও পেয়েছিল।
পার্সিপলিসের স্বপ্নাবেশ কাটবার আগে বেরসিক আয়াতুল্লাহরা শাহর পায়ের তলার মাটি সরিয়ে ফেললেন। একজন নিরুপায় রেজাশাহ পাহলভি কোনোমতে তেহরানের উপকণ্ঠে মেহরাবাদ বিমান বন্দর থেকে একটি অপেক্ষমাণ বিমানে করে পালিয়ে বাঁচলেন। ভাগ্যিস তিনি একজন বৈমানিক ছিলেন। ইরানের মাটি থেকে উড়াল দেয়ার সময় তার চোখ অশ্রুসিক্ত ছিল।
এই সে দিন পর্যন্ত আধুনিক মিসরের ফারাও হোসনি মুবারক জনরোষের প্রাক্কালে ব্রিটেনে পালিয়ে যাওয়া পুত্রকে তার পদে স্থলাভিষিক্ত করার ফন্দি আঁটছিলেন। তাহরির স্কোয়ারের গর্জনে মরুঝড়ের ঝাঁপটায় তছনছ হয়ে যায় সব কিছু। তার সব অপকর্মের সাথী স্ত্রী সুজান মুবারককে নিয়ে কায়রো থেকে পালিয়ে বাঁচেন। পরে আসামি হিসেবে প্রিজনভ্যানে আবার কায়রোয় এসেছিলেন এই অশীতিপর ক্যান্সার আক্রান্ত এক কালের দীর্ঘতম সময়ের মিসরীয় প্রেসিডেন্ট।
আমাদের নেতানেত্রীদের আচরণ উচ্চারণে মনে হয় না যে তাদের কোনো পতন হতে পারে। ক্ষমতার সাথে বিচ্ছিন্নতার কোনো প্রসঙ্গকে তারা সযতেœ এক পাশে সরিয়ে রেখে তারা বারবার নিজেদের অপরিহার্যতার প্রসঙ্গই টেনে আনেন। দেশ এখন কোনো স্বাভাবিক অবস্থায় নেই। লোডশেডিংয়ের দংশনে আমরা ভুক্তভোগীরা যখন ঘামে ভেজা শয্যায় এপাশ-ওপাশ করতে থাকি, কখন যে ডিজিটাল বাংলার স্বপ্ন উবে যায় এবং একটি তিক্ত অস্বস্তিকর অনুভূতি আমাদের ছেয়ে ফেলে! অর্ধেকের বেশি সময় বিদ্যুৎবঞ্চিত থাকা সত্ত্বেও মাসের বিদ্যুৎ বিল যে কিভাবে তিন-চার গুণ স্ফীত হয়ে যায় অঙ্কে দুর্বল আমি সে হিসাবও বুঝি না। ভয়ে ভয়ে যত শিগগির পারি নিজের প্রয়োজনীয় অনেক কিছুকে পেছনে ফেলে রেখে এই বিল পরিশোধকেই অগ্রাধিকার দেই। 
লেখক : অবসরপ্রাপ্ত ব্রিগেডিয়ার এবং নিরাপত্তা, রাজনীতি, বৈদেশিক নীতি ও আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিশ্লেষক

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন