শুক্রবার, ১১ মে, ২০১২

ইলিয়াস ইস্যুতে আন্দোলন ঠেকিয়ে আওয়ামী লীগের লাভ?








এম আবদুল হাফিজ


বিরোধী দলের চলমান আন্দোলনের কেন্দ্রীয় চরিত্র ইলিয়াস আলীর অবস্থান অপরিবর্তিত। তিনি অমাবস্যার চাঁদের মতো এখনও দেশবাসীর দৃষ্টিসীমার অš—রালে। ইতিমধ্যে ইলিয়াস আলীর স্ত্রী ও সš—ানরা প্রধানমন্ত্রীর বদান্যতায় তার সঙ্গে সা¶াতেরও সুযোগ পেয়েছেন, যদিও সরকারি তথ্যমতে ইলিয়াস আলীর সন্ধান সর্বোচ্চ অগ্রাধিকারের ভিত্তিতেই এগোচ্ছিল। একজন ডুবš— মানুষ খড়কুটো আঁকড়ে ধরেও বাঁচতে চায়। ইলিয়াসের স্ত্রী সম্ভবত প্রধানমন্ত্রীর মধ্যে সেই খড়কুটোই দেখতে পেয়েছিলেন। প্রধানমন্ত্রী ইলিয়াস আলীর স্ত্রীকে সদয় সহানুভ‚তির সঙ্গে সা¶াৎকার দেন এবং একজন ভুক্তভোগীর মানসিকতা থেকে ইলিয়াসকে উদ্ধারের আশ্বাস দেন। সেই আশ্বাস নিয়ে ইলিয়াসপতœী ফিরে এলেও এ নিয়ে জল্পনার অš— নেই। 
সমগ্র দেশবাসীর মনে এখন একথাই ঘুরপাক খাচ্ছে যে, সব সদিচ্ছা নিয়েও কী করতে পারেন প্রধানমন্ত্রী, যদিও তিনিই দেশবাসীর জন্য সর্বোচ্চ আশাভরসার স্থল। তাছাড়া এর কি গ্যারান্টি আছে যে আল­াহ না কর“ন ইলিয়াস এখন সব উদ্ধার প্রচেষ্টার ঊর্ধ্বে নন। ক’দিন আগে ওসমানী মিলনায়তনের এক অনুষ্ঠানে শ্রম প্রতিমন্ত্রী মন্নুজান সুফিয়ান ইলিয়াস পতœীকে ‘বিধবা’ বলে আরেক বিতর্কের জš§ দিয়েছেনÑ তাও আবার প্রধানমন্ত্রীর উপস্থিতিতে। গণভবনে ইলিয়াসকে উদ্ধারের আশ্বাসদানকালেও কিন্তু প্রধানমন্ত্রীর বডি ল্যাংগুয়েজ খুব একটা উৎসাহব্যঞ্জক মনে হয়নি। 
তবে একেবারে হঠাৎ করে না হলেও দেশের রাজনৈতিক দৃশ্যপট বেশ পরিবর্তিত। প্রতীয়মান হয় যে, সরকার বুঝে-সুঝেই হার্ডলাইনে চলে গিয়েছে। বিগত দিনগুলোতেও সরকার রাজপথে মারমুখো ছিল। কিন্তু এখন নীতিগতভাবেই সরকার হার্ডলাইনে, যা সরকারের প্রায় অšি—ম সময়ে সার্বিক পরিস্থিতি বিচারে একটি দমননীতিরই অংশ। এতদিন তবু কিছু রাখঢাক ছিল, কিন্তু এখন নমনীয়তার যেটুকু বাকি ছিল তারও মুখোশ খুলে ফেলে সরকার সর্বাÍকভাবেই ১৮ দলীয় জোটকে মোকাবেলা করতে চায়। এই জোটটি যখন সতর্কভাবে এগোচ্ছিল এবং জনগণের হরতালে সহ্যশক্তির তোয়াক্কা করে এবং বিদেশী বিশিষ্টজনদের সফরকে ঘিরে সাবধানী কর্মসূচি দিতে যাচ্ছিল, তখনই সরকার শীর্ষ নেতাদের অজামিনযোগ্য বিস্ফোরক মামলায় জড়িয়ে পুরো আন্দোলনেরই টুঁটি চেপে ধরতে উদ্যত হয়েছে। এভাবেই রাজপথকে নিজেদের দখলে রেখে মাত্র ক’জন বিএনপি নেতাকে এখন পর্যš— পুলিশের সাঁড়াশিমুক্ত রাখলেও তারা দলীয় নেতাদের জামিন ইত্যাদি আইনি হয়রানিতে আদালত প্রাঙ্গণেই নাভিশ্বাসগ্র¯—। 
যে কোন ¶মতাসীন দলের প¶ে জনমতে যখন ধস নামে, বিষয়টি তখন এমনই রূপ পরিগ্রহ করে। বলাই বাহুল্য আগামীতে এ রূপ আরও কদর্য হবে। ফলে উদ্ভ‚ত ডামাডোলের মধ্যে কোথায় ছিটকে পড়েছে বা পড়বে ইলিয়াস উদ্ধারের আন্দোলন। অতীতের অভিজ্ঞতা সা¶ী যে, এরও মধ্যে আন্দোলনের চালিকাশক্তি গজিয়ে ওঠে। এক দ্বার র“দ্ধ হলে অন্য দ্বার খুলে যায়। ঠিক আমাদের মহান ¯^াধীনতা সংগ্রামের মতো। তখনও সংগ্রামে উত্থান-পতন হয়েছে। 
তাছাড়া রাজনীতির ময়দানে টিকে থাকার লড়াই কোন সহজসাধ্য ব্যাপার নয়। তবু অনেকের দৃষ্টিতে বিএনপি তার সব কলঙ্ক নিয়ে শুধু আওয়ামী লীগের গোয়ার্তুমির বদৌলতে এক দীর্ঘমেয়াদি লড়াইয়ের প্রথম ধাপগুলো বেশ সাফল্যের সঙ্গে উৎরে এসেছে। অধুনা আরোপিত দমননীতির মামলা-হামলায় অভিযুক্তরা রাজনীতি বিশেষ করে মাঠের রাজনীতি এবং নেতৃত্ব দেয়ার ¶েত্রে পরিপক্ব হয়ে বেরিয়ে আসবে এবং এ প্রক্রিয়া তাদের বাড়তি আÍবিশ্বাসও দেবে। 
কিন্তু প্রশ্ন থেকেই যায় যে, তাহলে ইলিয়াস উদ্ধারের আন্দোলন কোন ভাগ্য বরণ করবে। ইলিয়াসের ধরাধামে অ¯ি—ত্ব নিয়েই যখন প্রশ্ন উঠেছে, আসলেই ইলিয়াস বা ইলিয়াসকে ঘিরে আন্দোলনের কী পরিণতি দাঁড়াবে? ইলিয়াসের যাই ঘটে থাকুক না কেন বা তার সমাপ্তি যেভাবেই ঘটুক, আন্দোলনের মূল ইস্যু কিন্তু রয়েই গেছে। তা হল একটি দলনিরপে¶ তত্ত¡াবধায়ক সরকারের অধীনে আগামী সাধারণ নির্বাচন। এ ইস্যুতে তো আগামী জুন মাসের প্রথম বা দ্বিতীয় সপ্তাহ পর্যš— বিএনপির সেই শর্ত পূরণের আলটিমেটাম দেয়াই আছে। সে ইস্যুতে মূল আন্দোলনে ইলিয়াস ছিল ছিটকে পড়া স্ফুলিঙ্গ। আন্দোলনের পথে চলতে এমনি হয়তো আরও একাধিক স্ফুলিঙ্গ ছিটকে বেরিয়ে আসবে। তাই একটি দমননীতির মাধ্যমে ইলিয়াস গুমের বির“দ্ধে আন্দোলন ¯—ব্ধ করে দেয়ার মধ্যে আওয়ামী লীগের বিশেষ কোন রাজনৈতিক প্রাপ্তি নেই। 
বিএনপি নেতৃত্বাধীন ১৮ দলীয় জোট বনাম আওয়ামী লীগ নেতৃত্বাধীন মহাজোট। রাজনীতির ¶মতার খেলায় এদের খেলাটির কিন্তু কোন ব্যত্যয় ঘটবে না, যদিও মাঝখান থেকে একজন খেলুড়ে ইলিয়াস হয়তো থাকবে না। সে¶েত্রে কিছু বিন্যাস সাপে¶ে নতুন সমীকরণ তৈরি হতে পারে, যা পূরনো সমীকরণের চেয়ে ১৮ দলীয় জোটের জন্য ভালো হতে পারে। আওয়ামী লীগ ইচ্ছে করলেও এতে তাদের অনুক‚লে শক্তির ভারসাম্য আনতে পারবে না। যে কোন বিচারে আমাদের রাজনৈতিক অঙ্গনে প্রাক-নির্বাচন জটিলতাগুলো রয়েই গিয়েছে। 
আওয়ামী লীগ তাদের শাসনের মেয়াদ ফুরিয়ে যাওয়ার প্রাক্কালে মনোবৈকল্যে ভুগছে, যার খেসারত হয়তো কিছু নির্দোষ নিরপে¶ ব্যক্তি বা গোষ্ঠীকে দিতে হবে। ২০০০ সালের প্রথম দশকের শেষ ভাগে বিএনপিও এমন øায়ুবৈকল্যে ভুগেছিল, যার পরিণতিতে আমাদের রাজনীতি কলুষিত হয়েছিল। চাইলে আওয়ামী লীগ সেই রাজনীতিকে একটি বিশোধন প্রক্রিয়ায় নিয়ে একটি সম্পূর্ণ নিষ্কলুষ রাজনৈতিক ধারার উদ্ভব ঘটাতে পারত। সেই অভিজ্ঞতা ও প্রয়োজনীয় উপাদানগুলো তাদের মধ্যে ছিল। শুধু তাদের মহানুভবতার মিশ্রণ ঘটানোর দরকার ছিল তাতে। কিন্তু ওই যে বঙ্গবন্ধুর বহুল উচ্চারিত আপ্তবাক্য, চোরা না শোনে ধর্মের কাহিনী। মহৎ কিছু রাজনৈতিক রূপাš—র শুধু মানসিকতার ব্যাপার। 
সুযোগ বিএনপি বা আওয়ামী লীগ উভয়ের কাছেই এসেছিল পর্যায়ক্রমে। কিন্তু উভয়েই রয়ে গেল নির্মমভাব ইতিহাসবিমুখ। তারা শুধু এক ক্লেদাক্ত বর্তমানকেই আঁকড়ে ধরে থাকল। তাদের রাজনীতির উজ্জ্বলতম মুহূর্তগুলো এমনিভাবেই তাদের হাতছাড়া হয়ে গেল। অবশ্য আওয়ামী লীগের এখনও সময় আছে বা¯—বতার নিরিখে রাজনীতির মান নিরূপণের। আমাদের প্রধানমন্ত্রীকে তার দলীয় সমর্থকরা রাষ্ট্রনায়কোচিতরূপে দেখে। রাষ্ট্রনায়করা কিন্তু নগদ প্রাপ্তিকেÑ তা যতই আকর্ষণীয় হোকÑ তুড়ি মেরে ইতিহাসে তাদের স্থান খোঁজে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে মিত্রবাহিনীর বিজয়ের অন্যতম স্থপতি চার্চিলকে ব্রিটিশ জনগণ যুদ্ধকালীন নির্বাচনেই প্রত্যাখ্যান করেছিল। নোবেল পুরস্কার বিজয়ী এই রাষ্ট্রনায়ককে কিন্তু ইতিহাস প্রত্যাখ্যান করতে পারেনি। 
দেশের চলমান রাজনীতির যেদিকেই বাঁকপরিবর্তন হোক, ইলিয়াস উদ্ধারের নৈতিক দায়িত্ব কিন্তু আওয়ামী সরকারের ঘাড় থেকে অপসারিত হবে না। এটি মানবিক ইস্যু। যে কোন মূল্যে এর সঙ্গে রাজনীতির তিল পরিমাণ মিশ্রণ সর্বতোভাবে পরিত্যাজ্য। প্রধানমন্ত্রী নিজে এই ইস্যুর মানবিক ডাইমেশনকে উপে¶া করেননি। আমরা অধীর আগ্রহে তাকিয়ে আছি শুধু দেখতে যে, আপাতভাবে অনিশ্চিত এই ইস্যুর দুর্ভেদ্যতা ভেদ করে প্রধানমন্ত্রী ইতিহাসে তার স্থান নিশ্চিত করবেন। অতঃপর রাজনীতি চলতে থাকবে তার আপন বৃত্তে। কেউ হারবে, কেউ জিতবে, যার চ‚ড়াš— সমাপ্তি ঘটে শেষ পর্যš— তুচ্ছাতিতুচ্ছের ভেতর দিয়েই। 
এম আবদুল হাফিজ : নিরাপত্তা বিশে­ষক ও কলাম লেখক

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন