সোমবার, ৪ জুন, ২০১২

হ্যামিলনের বংশীবাদকরা!




এম আবদুল হাফিজ
খুব দুর্দিনে আছে এক সময়ের দোর্দণ্ড প্রতাপশালী বিএনপি। এতটাই যে, কোন মতে দলটি এখন তার অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখার লড়াইয়ে ব্যস্ত। দলটির সব শীর্ষ নেতাই এখন সরকারের গৃহীত হার্ডলাইন বা এক প্রচণ্ড দমননীতির শিকার হয়ে কারান্তরালে। অতি উৎসাহী দলীয় কর্মীরা বিক্ষোভ-আন্দোলন করতে চাইলেও আইন-শৃংখলা বাহিনীর পুলিশ-র‌্যাবসহ আওয়ামী ক্যাডাররা তাদের কোথাও দাঁড়াতেই দেয় না। পিটিয়ে রাজপথ থেকে তাড়িয়ে দেয়। বাদকরা অন্তরালে থাকলেও বাঁশির মূর্ছনা এদের শ্র“তিগোচর হয়েছে এবং তা তাদের বারবার ঘরছাড়া করে। বিএনপির সাম্প্রতিক কর্মসূচিগুলো তা-ই প্রমাণ করে। জ্যৈষ্ঠের দাবদাহ এবং খররৌদ্রের প্রতিকূলতা উপেক্ষা করে কিছু প্রতিবাদী তর“ণ যেভাবে মারমুখো ‘আইন-শৃংখলা’ বাহিনীর সদস্যদের মুখোমুখি হয়েছে, তা অনেককেই অবাক করেছে। 
অনেকেই বলেন, আওয়ামীরাও এক সময়ে বিএনপির এমন চণ্ডরূপের মোকাবেলা করেছে। সে কথা সত্য। কিš‘ আজকের আন্দোলনের পরিধি বেশ কিছুটা বিস্তৃত। বিষয়টি আর অন্তঃদলীয় নয়। ন্যায়-অন্যায়ের অনেক ইস্যুই এর সঙ্গে যুক্ত হয়েছে। এর কারণ আওয়ামীরা এক সুদূরপ্রসারী উদ্দেশ্য নিয়ে এদেশের মানুষের মননের বিপরীতে কিছু মৌলিক পরিবর্তনে হাত দিয়েছে, যা ঠেকানো একটি বিশাল জনগোষ্ঠীর কাছে পবিত্র দায়িত্ব। সেই দায়িত্ববোধ থেকেও অনেকে প্রতিবাদের কাতারে স্বতঃস্ফূর্তভাবে দাঁড়ান। অনেকেই তাদের সরল বিশ্বাস থেকে প্রশ্নের সম্মুখীন হন, এদেশ কি আবার বাকশালী আদলে ফিরে যাবে? অনেকে ভাবেন, এ দেশ কি আর আমাদের বিশ্বাসের ভিত্তিতে টিকে থাকবে। 
সময়ের এমনই এক সন্ধিক্ষণে হ্যামিলনের কিছু বাদক তাদের বাঁশিতে তান তুলেছে আরেক লড়াইয়ের জন্য বিদ্রোহী-প্রতিবাদীদের রাজপথে টেনে আনতে। রক্তচক্ষু সরকারের শাসানির মুখেও এরা ঘর ছাড়ছে। প্রত্যয়দীপ্ত কণ্ঠে তাদের সেই একই উ”চারণÑ সময় এখন মিছিলে যাওয়ার। যুগে যুগে এমনটাই হয়েছে। প্রতিবাদীরা তাদের পরিণতি নিয়ে কালেভদ্রে হিসাব-নিকাশ করে। করলে তারা এর প্রতিবন্ধকতার মুখোমুখি হতে চাইত না। এটাকে শুধু এক সুন্দর আগামীর জন্য ঝুঁকি গ্রহণ বললে ভুল হবে। এটা রীতিমতো গ্যাম্বলিং। 
জুয়াতে স্টেইক থাকে। আজকের এই মারমুখী রাজনীতিতেও স্টেইক আছে। এবং তা উভয় প্রধান দলের জন্যই আছে। রাজনীতিতে অনেক কিছুই উহ্য থাকে। প্রকাশ্যে দু’দলই দেশ ও জনগণের জন্য সমর্পিত প্রাণ। উভয়েই গণতন্ত্রকে নিষ্কলুষ করতে চায়। কিš‘ অন্তরে তাদের ক্ষমতা প্রলম্বিত ও দখল করার লিপ্সা। রাজনীতির আরেক গুর“ত্বপূর্ণ পক্ষ জনগণ। তাদেরও রাজনীতির চলমান খেলায় স্টেইক আছে। রাজনৈতিক খেলার সুবাদে তারাও তাদের ভাগ্যোন্নয়নের চেষ্টায় প্রবৃত্ত হয়। এমন একটি দলকে তারা দেশ পরিচালনার জন্য বেছে নেয়, যেটি তাদেরকে তাদের ঈপ্সিত শাসন উপহার দিতে পারে, যদিও অতীতে কোন দলই তা পারেনি বা দেয়নি। তবু তারা একটি আশাবাদ গিয়ে রাজনীতির খেলায় শরিক হয়। 
আওয়ামীদের দিয়েই এদেশে দেশ শাসন শুর“ হয়েছিল। এখন তারা তৃতীয় মেয়াদে দেশ শাসন করছে। তাদের দেশ শাসনের রেকর্ড কোন সময়ই উৎসাহব্যঞ্জক হয়নি। কর্তৃত্ববাদী এ দলটি দেশ ও জনগণের কল্যাণে বেশি কিছু দেয়নি। কিš‘ তাদের উক্তি-উ”চারণে অন্য চিত্র। তারা ক্ষমতায় এলেই নাকি জনগণ কিছু পায়। অন্যরা ক্ষমতায় আসে শুধু লুটপাটের জন্য। এই ‘পাওয়ার’ তাদের নিজস্ব ব্যাখ্যা আছে। কিš‘ আসলে দলীয় নেতাকর্মীরাই কিছু পায়। তারাও তো জনগণের অংশ। কিš‘ জনগণের স্বার্থে আওয়ামীরা কদাচিৎ কিছু করেছে। তারা যে অন্ধকারে ছিল তা আরও ঘনীভূত হয়েছে, তারা যে দারিদ্র্যে ছিল তা আরও প্রকট হয়েছে। 
একই রেকর্ড বিএনপির দেশ শাসনেরও। তখনও ব্যাপক দুর্নীতি, দারিদ্র্য ও সামাজিক বৈষম্য ছিল। ‘দেশনেত্রী’ তার শাসনামলে একইভাবে ক্ষমতার দাম্ভিকতায় ছিলেন এবং বিরোধীদের তু”ছ-তা”িছল্য তার শাসন-শৈলীর অংশ ছিল। উ”ছৃঙ্খল এক ‘হাওয়া ভবন’ রহস্য কাহিনী এখনও ত্রাসের সঞ্চার করে। সে সময়কার ‘বিদ্যুৎ’ কেলেংকারি, মুদ্রা পাচার এবং স্বজন তোষণ কম নিন্দিত হয়নি। তবে বেগম খালেদা জিয়ার একটি গুণ অনেকেরই দৃষ্টি এড়ায়নি। রাষ্ট্র পরিচালনায় নেতা-নেত্রীদের এবং কর্তাব্যক্তিদের প্রয়োজনে বিদেশ ভ্রমণ জর“রি। কিš‘ এখনকার মতো প্রয়োজনে-অপ্রয়োজনে তাদের বিদেশ ভ্রমণের নামে ‘প্রমোদ ভ্র্রমণের’ এত আধিক্য ছিল না। কেননা খালেদা জিয়া স্বয়ং অনেকটাই ভ্রমণবিমুখ। 
শাসকগোষ্ঠী যে পথেই চলুক না কেন, সরকারের বিচ্যুতি ও বিপথগামিতার বির“দ্ধে সো”চার তো হবেই প্রতিবাদী তার“ণ্য। তাই আন্দোলন কোন কোন সময়ে দলমতের ঊর্ধ্বে থেকে প্রতিবাদের ভাষা উ”চারণ করে। এ মুহূর্তেও তাই হ”েছ এবং হবে। জনজীবনের অশেষ ভোগান্তি রাজনৈতিক ইস্যুর সঙ্গে একাকার হয়ে এক সার্বজনীন ক্ষোভে-দ্রোহে পরিণত হ”েছ। তারই বিস্ফোরণোš§ুখ প্রকাশ আমরা রাজপথে দেখি। অবশ্য ক্ষমতাসীনদের সুসংগঠিত বিক্ষোভ-আন্দোলনে একই প্রকার দ্রোহ থাকবে না বরং এক ধরনের প্রভুভক্তি ও কৃতার্থতার প্রকাশ থাকবে তাদের ‘কার্য সম্পাদনে’। বাংলাদেশ প্রচণ্ড বিদ্রোহী ও হীনতম তাঁবেদারের আবাসভূমি। 
প্রতিবাদীদের কাছে তাদের আন্দোলন-বিক্ষোভ, ন্যায়-অন্যায়ের যুদ্ধে নিষ্কলুষ ন্যায়ের পক্ষে। ন্যায়ের পক্ষে থাকার একটি মনস্তাত্ত্বিক শক্তি আছে, যা ক্ষমতাসীনদের বির“দ্ধে একটি অসম যুদ্ধে প্রতিবাদীদের চালিকাশক্তি জোগায়। একটি অদৃশ্য অপরাধবোধ নেপথ্যে কাজ করে বলে ক্ষমতাসীনদের দলীয় ক্যাডারদের সব সময় যুদ্ধের রক্ষণভাগে থাকতে হয় এবং ‘ভাড়াটে’ ভূমিকায় থাকার হীনমন্যতায় ভুগতে হয় এবং তাদের আচরণ স্বতঃস্ফূর্ততা পায় না। 
পুরো বিষয়টাকে আমরা যে দৃষ্টিকোণ থেকেই দেখি না কেন, আগামী দিনগুলো অর্থাৎ দশম সংসদের নির্বাচনকাল পর্যন্ত সময়টি ঝঞ্ঝা-বিক্ষুব্ধই থাকবে। কেননা উভয়পক্ষেই এ সময়ে নিজ নিজ দৃষ্টিকোণ থেকে ঝুঁকি অনেক প্রকট। কোন পক্ষই দায়-দায়িত্বের এই ঝুঁকি নিতে চাইবে না। রাজনীতিকরা হ্যামিলনের বংশীবাদকের মতো রাজপথ গরম রাখতে স্ব-স্ব কর্মীবাহিনীকে ঘরছাড়া করে রাজপথে জমায়েত করতে তাদের বাঁশিতে এক প্রকার মায়াবী তান তুলবে। এতেই এক অবাধ্য তার“ণ্য দিগি¦দিক জ্ঞানশূন্য হয়ে রাজপথে ছুটবে। 
সংলাপবাদীরা কী করছেন এ সময়ে? হিলারি ক্লিনটন থেকে ড্যান মজিনা এবং আমাদের সুশীলসমাজ ও বিশিষ্টজনেরা? সংলাপ এমনিতে হয় না। সংলাপের পর্যায় পর্যন্ত আসতেও অনেক কাঠখড় পোড়াতে হয়। রাজপথে অনেক তুলকালাম ঘটার পরই রথী-মহারথীরা এখন সংলাপের কথা বলছেন, যদিও এর যৌক্তিকতা অনেক আগেই অনুভূত হয়েছিল। সুতরাং এটা বোঝা যা”েছ যে, রাজপথের পর্বটা অসমাপ্ত থাকার কারণেই সংলাপের জিগিরটা উত্থাপিত হওয়ার অপেক্ষায় ছিল। 
মানুষের কল্যাণ অত সহজে না হলেও তার প্রতিবিধানে অনেক চড়াই-উৎরাই আছে। আশাবাদ বুকে পুষে সেই দুর্গম পথ পাড়ি দিতেই হয়। সেই পথ পাড়ি দেওয়ানোর জন্য অক্লান্ত রাজনৈতিক বংশীবাদকরা তাদের বাঁশিতে তান তোলেন। এখনও, এ মুহূর্তেও সেই প্রক্রিয়াই চলমান।
এম আবদুল হাফিজ : নিরাপত্তা বিশ্লেষক, কলাম লেখক

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন