॥ এম. আবদুল হাফিজ ॥
গ্রীষ্মের দাবদাহ, তীব্র লোডশেডিং ও রাজনৈতিক পারদের ঊর্ধ্বমুখীতায় প্রাণ ওষ্ঠাগত এ দেশের মানুষের। কোনো সঙ্কেত নেই যে, শিগগিরই এই অবস্থার কোনো ইতিবাচক পরিবর্তন হবে। বরং ক্রমবর্ধমান রাজনৈতিক অস্থিরতা সরকার থেকে ভিন্ন মতাবলম্বীদেরসহ বিরোধীদলীয় শীর্ষ নেতাদের ব্যাপক ধরপাকড় ইতোমধ্যে ত্রিশঙ্কু অবস্থায় নিপতিত দেশের অস্থিতিশীলতার নতুন মাত্রা যোগ করেছে। দেশের নেতা-নেত্রীরা বারুদের ভাষায় কথা বলছেন, একে অপরকে শিক্ষা দিতে শাসাচ্ছেন এবং রাজপথ ও রাজনৈতিক পরিমণ্ডল দখলে রাখতে মরিয়া হয়ে উঠেছেন। তাদের মধ্যে সংঘর্ষের স্ফুলিঙ্গ জ্বলে উঠতে পারা মুহূর্তের ব্যাপার। অভিজ্ঞতা বলে যে, এ থেকেই রাজনৈতিক দাবানলের উৎপত্তি হবে।
তা ছাড়াও নাগরিক জীবনের বেহাল অবস্থা তো আছেই। তা নিয়ে দেশবাসী আর মাথা ঘামায় না। এই জনমের কখন কোন সময়ে দুধকলা সহকারে ভাত বা চিঁড়া খেয়েছিল সেই সুখ স্মৃতির মধ্যে দেশবাসী তৃপ্তি খোঁজে। মহার্ঘতার কশাঘাতে জর্জরিত মানুষের যখন দু’বেলা পেট পুরে খেতে পারাটাই একটা বিরাট বিষয়, কয়েক ঢোক বিশুদ্ধ পানি পান করতে পারলেই তা হয় বিরাট প্রাপ্তি। তাই কখনো বাগে না আসা বাজারের বাজারদর নিয়েও মাথা ঘামায় না মানুষ। পেলে খায়, না পেলে চুরি করে, মার খায়। তা ছাড়া ভিক্ষাবৃত্তি তো আছেই।
তবু দেশবাসী ভোটের প্রাক্কালে হঠাৎ করেই গুরুত্বপূর্ণ ও শক্তিশালী হয়। দেশের শীর্ষ নেতা-নেত্রীরা আসেন তাদের কুঁড়েঘরের দোরগাড়ায় ভোট ভিক্ষা চাইতে। এতে করেই তাদের পলিমাটির মতো মন বিগলিত হয়। একবার এদের ভোটে নির্বাচিত হয়েই সেই যে ডুমুরের ফুল হয়ে যায় দেশের দেশনেত্রী, দেশরতœ ও পল্লীবন্ধুরা, পাঁচ বছরেও এদের আর সাক্ষাৎ মেলে না। সেই সরলপ্রাণ ও অল্পেতুষ্ট দেশবাসীকে বারবার প্রতারিত করে এ দেশের রাজনৈতিক নেতৃত্ব। আবার তারা সক্রিয় আগামী নির্বাচনের প্রাক্কালে।
বলা বাহুল্য, ভোটের লড়াইয়ে আপাত ক্ষমতাসীনরাই এগিয়ে থাকে। হঙ্কার ও শাসানোতে এবারো আওয়ামীরাই অগ্রণী। তাদের তা করার রসদও আছে। ক্ষমতার দণ্ড যতক্ষণ হাতে আছে, তারাই লোককে অবলাইজ করতে পারে। পারে চাকরিবাকরি, ঠিকাদারি, ব্যবসায় ও ভালো নিয়োগ দিতে। কিছুই না হোক, কারো ফাই ফরমায়েশের জন্য হরহামেশা বিদেশ সফরকারী কর্তাব্যক্তিদের সাথে বিদেশে প্রমোদ ভ্রমণের জন্য পাঠাতে পারে। নিদেনপক্ষে গণভবন দর্শনের মওকা করে দিতে পারে খোদ প্রধানমন্ত্রীর অমৃতবাণী শোনার অসিলায়।
অবাক কাণ্ড ঘটেছে আমাদের দেশরতœ প্রধানমন্ত্রীর জনপ্রিয়তা ও গ্রহণযোগ্যতায়। খোদ যুক্তরাষ্ট্রের এক গ্যালাপ প্রতিষ্ঠান বলেছে, দেশে শতকরা ৭৭ ভাগ মানুষের কাছে গ্রহণযোগ্যতা পেয়ে আমাদের প্রধানমন্ত্রী বিশ্বের সবচেয়ে জনপ্রিয় রাষ্ট্রনায়কদের শীর্ষে রয়েছেন। তাহলে আওয়ামীদের তো কেল্লা ফতেহ। তা হলে আর আওয়ামী নেতা-নেত্রী রোদে গরমে ঘর্মাক্ত কলেবরে এত দৌড়ঝাঁপ করছেন কেন? তা কি অবশিষ্ট শতকরা ২৩ ভাগ জনসমর্থন বিরোধীদের কাছ থেকে ছিনিয়ে নিতে? হয়তো বা।
কিন্তু আফসোস ! আওয়ামীরা এ দেশবাসীকে এতটাই বিচার-বুদ্ধিবর্জিত মনে করল কেন? দেশজ জনমত জরিপে তাদের জনপ্রিয়তার স্বরূপ বেরিয়ে আসত বলে একটি দুঃশাসনপীড়িত দেশবাসী তাদের দুঃখের কথাই অকপটে বলত বলে? এ পর্যন্ত তাদের আওয়ামী বিরূপতার প্রকাশ ঘটাত বলে? এ দেশের সব দল সংগঠনই ভুয়া সাফল্যের সার্টিফিকেট চায় এবং তা আমেরিকা, ব্রিটেন বা ইউরোপের হলে তারা বেশি আশ্বস্ত হয়, যদিও বা তা ভুয়া। এ দেশের মানুষের সত্য ভাষণ তাদের যম এবং তা তারা সযতেœ এড়িয়ে চলে।
অথচ আমাদের চাইতে কে ভালো বুঝবে যে দুঃশাসনের জ্বালা কী? তাতে কোন কোন দানবের সৃষ্টি হয়, দারিদ্র্য ও বৈষম্যের উৎস কোথায়, দুর্নীতির সংক্রমণ কোথা থেকে হয়। সুরঞ্জিত সেনরা কোন সংস্কৃতির সৃষ্টি? আলো-আঁধারির মতো তার মন্ত্রিত্ব যাওয়া ও আসার মধ্যে কোথাকার কলকাঠি নড়ে। দেশময় এত হত্যা ও অপহরণের রহস্য কী? ইলিয়াস আলী ও চৌধুরী আলম উদ্ধার হন না, কিন্তু নদী-জলাশয়, ডোবা-গর্ত ও ক্ষেত-প্রান্তরে এত বেওয়ারিশ লাশের ছড়াছড়ি। পুরো দেশটাকে মনে হয় একটি বধ্যভূমি।
দিন যত পেরিয়ে যাবে, নির্বাচন আরো নিকটবর্তী হবে, ক্ষমতাসীনেরা ক্ষমতা আঁকড়ে থাকার আরো আনকোরা নতুন নতুন কৌশলের উদ্ভব ঘটাবে। একই ক্ষমতাসীনেরা স্বাধীনতার ঊষালগ্ন থেকে ক্ষমতা কুক্ষিগত করার ফন্দিফিকিরে লিপ্ত হয়েছিলেন এবং গণতন্ত্রকে নির্বাসনে পাঠিয়ে একদলীয় শাসন ব্যবস্থার প্রবর্তন করেছিলেন। এ কথা অনস্বীকার্য যে, এই দলটিই আবার স্বাধীনতা সংগ্রামেরও নেতৃত্ব দিয়েছিল। এই দলটিই গণতন্ত্র ও সমাজতন্ত্রের মূলনীতিকে সংবিধানভুক্ত করেও পরে এই নীতিগুলোকে বিসর্জন দিয়েছিল। জনগণ তবু বঙ্গবন্ধুকে ভালোবেসে এই দলকে বারবার ক্ষমা করেছে। আওয়ামীরা কি মনে করে যে, জনগণ আবার তাই করবে?
দেশে এখন দুঃশাসন চলছে। শুধু নির্বাচিত পার্লামেন্ট থাকলেই গণতন্ত্র হয় না। গণতন্ত্র না থাকলে দেশে সুশাসনও প্রতিষ্ঠিত হতে পারে না। চলমান দুঃশাসনের শেষ কী বা কোথায় অনুমান করাও কঠিন। কেননা দেশে কোনো কিছুর স্বাভাবিক প্রক্রিয়া সক্রিয় নেই। আমি সাবেক রাষ্ট্রপতি বদরুদ্দোজার কোনো ভক্ত-সমর্থক নই, তবু তিনি এক চমৎকার অভিব্যক্তিতে বর্তমান সরকারের কীর্তির প্রকাশ ঘটিয়েছেন। তিনি বলেছেন, আওয়ামীরা আর কিছু না পারুক, দেশটিকে ‘লণ্ডভণ্ড’ করে দিয়েছে। হ্যাঁ লণ্ডভণ্ডই বৈকি! সংস্কার সংশোধনের নামে তারা দেশের সংবিধানই শুধু নয়, অনেক মৌলিক ইস্যুতে জনমতের তোয়াক্কা না করে তাদের বা তাদের দেশী-বিদেশী বন্ধুদের স্বার্থে পদক্ষেপ নিয়েছে, যা দেশের দীর্ঘমেয়াদি স্বার্থের জন্য ক্ষতিকর। জানি না সেই বিচ্যুতিগুলো আদৌ কিভাবে দূর করা যাবে। যদিও বিএনপির ট্র্যাক রেকর্ড খুব ভালো নয়, কিন্তু এ সময়ে দলের মধ্যপর্যায়ের নেতৃত্বে কিছু প্রতিশ্রুতিশীল মুখের সন্ধান মেলে। রাজপথেও তারা দুর্বার। ভবিষ্যতে তারা কিসে পরিণত হবে এ মুহূর্তে তা বোধগম্য না হলেও গণতন্ত্রের খাতিরেই দেশে একটি বিরোধী সংগঠন থাকতেই হবে। সেই দৃষ্টিকোণ থেকে সরকারের একটি চণ্ড দমননীতি বিএনপির যে ক্ষতি করবে তার চেয়ে অনেক বেশি ক্ষতি করবে গণতন্ত্রের। সরকারের ইচ্ছা ও অনিচ্ছাকৃত বিপথগামিতাকে সে ক্ষেত্রে ধরিয়ে দেয়ার কেউ থাকবে না। সরকার ব্যক্তি ও দলগত স্বার্থ উদ্ধারে ইতোমধ্যেই বেপরোয়া। একটি বিরোধী দলবিহীন রাজনৈতিক শূন্যতায় আদর্শবিচ্যুত সরকারি দল তখন মেয়াদের বাকি সময়টুকু লুটেপুটে আখের গোছাতে ব্যস্ত হয়ে পড়বে। তাহলে? সংলাপ? সেও আরেক মরীচিকা, যার পেছনে, হ্যামিলনের বংশীবাদকের পেছনে ছোটার মতো, ছুটছে বিভ্রান্ত কিছু লোক।
লেখক : অবসরপ্রাপ্ত ব্রিগেডিয়ার এবং নিরাপত্তা, রাজনীতি, বৈদেশিক নীতি ও আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিশ্লেষক
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন